বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১

আরেকটি ক্ষুদ্রঋণ প্রণোদনা আসছে, সরকার ৫ শতাংশ ভর্তুকি দেবে

প্রকাশিত: ০৫:২০ এএম, ডিসেম্বর ১৯, ২০২০

আরেকটি ক্ষুদ্রঋণ প্রণোদনা আসছে, সরকার ৫ শতাংশ ভর্তুকি দেবে

নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (সিএমএসএমই) জন্য যে ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটা বিতরণে হতাশাজনক অবস্থা সত্ত্বেও সরকার নতুন আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এর পরিমাণ হবে ১০ হাজার কোটি টাকা। এই প্যাকেজের আওতায় কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র (সিএমএসই) উদ্যোক্তাদের ঋণসুবিধা দেওয়া হবে। বাদ দেওয়া হয়েছে মাঝারি উদ্যোক্তাদের। সিএমএসএমই খাতে চলতি মূলধন সুবিধা দিতে আগে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করা হয়। এ তহবিল থেকে ৯ শতাংশ সুদহারে গ্রাহকদের ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। এর মধ্যে সরকার ৫ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে দিচ্ছে। প্যাকেজটি বাস্তবায়নের জন্য সময় বাড়িয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে নতুন করে সিএমএসই খাতে সরকার যে ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করতে যাচ্ছে, সেখানে গ্রাহকদের সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ সুদ দিতে হবে। এর মধ্যে সরকার ৫ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে দেবে। আগের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন না করে নতুন প্যাকেজ ঘোষণার সিদ্ধান্তকে ‘অবিবেচনাপ্রসূত’ বলেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা বলছেন, পুরনোটি আগে বাস্তবায়ন করা উচিত। সুদের হার নিয়ে তাঁরা বলছেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঋণখেলাপিতে পরিণত হতে পারেন। করোনা মোকাবেলা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এর আগে সরকার ২১টি খাতে এক লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সেখান থেকে সিএমএসএমই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা চলতি মূলধন হিসেবে দেওয়ার কথা। নতুন করে আবার সিএমএসই খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলে ২২টি খাতে প্রণোদনা প্যাকেজের মোট পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ৩১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। নতুন প্রণোদনা খাতে সরকারকে ভর্তুকি বাবদ ৫০০ কোটি টাকা সুদ ব্যয় গুনতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্ষুদ্র শিল্পগুলোর কথা চিন্তা করেই সরকার এ প্রণোদনা আনবে। এতে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে, কর্মসংস্থান হবে। এ ব্যাপারে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর অব ফিন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট অসিত বরুণ দাস বলেন, ‘সরকার নতুন যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করবে, সেখান থেকে আমরা কোনো মুনাফা করব না। রাষ্ট্রের জনহিতকর কাজে আমরা থাকতে চাই। এখানে চ্যালেঞ্জ হলো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমাদের চাহিদামতো অর্থের জোগান দিতে পারবে কি না। তবে আমরা মনে করি, আগের প্যাকেজে ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র শিল্পগুলো পর্যন্ত পৌঁছতে না পারলেও আমরা তা পারব। এতে এসব শিল্প উপকৃত হবে।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সিএমএসএমই খাতে তিন বছর মেয়াদি যে ২০ হাজার কোটি টাকা চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ প্রণোদনা বিতরণ হচ্ছে এর বেশির ভাগই পেয়েছে মাঝারি শিল্প। তাই সরকার মনে করছে, এ খাতের জন্য নতুন করে আপাতত কোনো প্রণোদনার দরকার নেই। বরং এ খাতটি বাদে বাকিগুলোর আরো সহায়তা দরকার। সে হিসেবে ২২তম প্রণোদনা প্যাকেজ হিসেবে কুটির, অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র (সিএমএসই) খাতকে দেওয়া হবে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তা। এ প্যাকেজের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। প্যাকেজটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক, মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ), বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলো (এমএফআই)। এতে অর্থায়ন করবে সব তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আর গ্রাহক পর্যায়ে অর্থায়ন করবে এমআরএ থেকে সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো। নতুন প্যাকেজটি অনুমোদনের জন্য আগামী মন্ত্রিপরিষদে তোলা হতে পারে। এ জন্য গত বৃহস্পতিবারই তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন প্রণোদনা প্যাকেজের ৪৫ শতাংশ ঋণ যাবে অনুৎপাদনশীল খাতে (ব্যবসা)। আর ৫৫ শতাংশ উৎপাদন ও সেবা খাতে বিরতণ করা হবে। কে কত সুদে টাকা পাবে : গ্রাহক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ঋণের সীমা হবে ৫০ লাখ টাকা। তবে কটেজ বা কুটির শিল্প পাবে পাঁচ লাখ টাকা। অতি ক্ষুদ্র শিল্প ঋণ পাবে ১০ লাখ টাকা। আর ক্ষুদ্র শিল্পগুলো সর্বোচ্চ পাবে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত। প্যাকেজের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক .৫ শতাংশ হারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়ন করবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ২.৫ শতাংশ সুদহারে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলোকে অর্থায়ন করবে। ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলো গ্রাহক পর্যায়ে অর্থায়নের বিপরীতে সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ হারে সুদ নেবে। এর মধ্যে গ্রাহককে দিতে হবে ৯ শতাংশ। বাকি ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে পরিশোধ করবে। সরকার এ টাকা ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলোকে পরিশোধ করবে। ঋণগ্রহীতা উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ এক বছর ভর্তুকি সুবিধা পাবে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলোকে বিদ্যামান ঋণ স্থিতির ২-৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ/বিনিয়োগ দিতে পারবে। ঋণ বিতরণে পৃথক নীতিমালা : ক্ষতিগ্রস্ত সিএমএসই খাতে নতুন প্রণোদনায় ঋণ বিতরণে সরকার পৃথক একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। নীতিমালার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্যাকেজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমআরএ থেকে আবেদনকারী ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের ঋণপ্রাপ্তির সক্ষমতাবিষয়ক প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে। অর্থায়নকারী ব্যাংক থেকে অনুরোধ পাওয়ার তিন কার্যদিবসের মধ্যে এমআরএ ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের ঋণপ্রাপ্তির সক্ষমতাবিষয়ক প্রত্যয়নপত্র সরবরাহ করবে। ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়নপত্র পাওয়ার সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমএফআই পর্যায়ে ঋণ বিতরণের কাজ সম্পন্ন করবে। ঋণপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এমএফআই গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ বিতরণ নিশ্চিত করবে। একটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ তিন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে সব ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের সমষ্টি এমএফআইয়ের ঋণপ্রাপ্তির সর্বোচ্চ সীমার মধ্যে থাকতে হবে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমএফআইকে যে ঋণ দেবে এর মেয়াদ হবে দুই বছর। এ নীতিমালার আওতায় ঋণ নিয়ে বিদ্যমান কোনো ঋণ সমন্বয় বা পরিশোধ করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এর আগে সরকার সিএমএসএমই খাতে যে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল এর বেশির ভাগই বিতরণ হয়নি কাগজপত্র ও নিশ্চয়তার কারণে। নতুন প্রণোদনায় সরকার বলছে, গ্রাহকের ঋণ আবেদনের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্ম নিবন্ধন সনদ/পাসপোর্টের কপি থাকতে হবে। পাশাপাশি ট্রেড লাইসেন্স/সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন/ পৌরসভার কাউন্সিলর/ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র থাকতে হবে। যেকোনো দুজনের নিশ্চয়তা দাখিল করতে হবে। পুরনো প্রণোদনার অর্থ এখনো বিতরণ বাকি : ছোট উদ্যোক্তা অর্থাৎ সিএমএসএমই খাতে চলতি মূলধন হিসেবে সরকার আগে যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, এর আওতায় ঋণ বিতরণ শুরু হয় গত ১৩ এপ্রিল থেকে। কিন্তু কাগজপত্র দাখিলে কড়াকড়ি, ঋণ ফেরত আসা নিয়ে অনিশ্চয়তাসহ নানা জটিলতায় ব্যাংকগুলো ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণে অনীহা দেখাচ্ছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই ঋণ বিতরণের সময়সীমা বাড়ানো হলেও মেলেনি প্রত্যাশিত ফল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ থেকে গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে আট হাজার ২১৮ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার অবিবেচকের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিএমএসএমই খাতের আগের প্রণোদনা প্যাকেজটি যেখানে ৪০ শতাংশের মতো বাস্তবায়িত হয়েছে, সেখানে নতুন প্রণোদনা কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’ আগের প্যাকেজ বাস্তবায়ন করার পর নতুন প্যাকেজ ঘোষণা করলে ভালো হবে বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘নতুন প্রণোদনাটি যদি এমএফআইয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয় তাহলে রুট লেভেল পর্যন্ত পৌঁছানোর সম্ভাবনা আছে। তবে আগের প্রণোদনাটি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তাই সেটিও যাতে বাস্তবায়িত হয়, তা দেখতে হবে।’
Link copied!