বার্ষিক মাত্র ৫ শতাংশ সুদে মিলবে কোটি কোটি টাকা ঋণ। কোনো কিছু বন্ধক রাখার প্রয়োজন নেই। ঋণ পেতে সময়ও লাগবে খুব কম, পাঁচ দিনের মধ্যেই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এত সুবিধা দেখে আগ্রহী হয়ে ওঠেন অনেকেই। তখন জানানো হয়- ঋণ পেতে কিছু কমিশন দিতে হবে, পরে যা সুদের সঙ্গে সমন্বয় করে নেবে কর্তৃপক্ষ। সেই কমিশনের পরিমাণ ঋণের অঙ্কভেদে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দাঁড়ায়। এভাবে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ইডাফ ফাউন্ডেশন। তবে এখন পর্যন্ত ঋণ পাননি কেউ। কমিশন হিসেবে জমা নেওয়া টাকাও ফেরত পাননি। বরং প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিজের সম্বলটুকুও খুইয়েছেন অন্তত আড়াই হাজার ব্যবসায়ী।
জানা যায়, রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএস এলাকার ৬ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির পঞ্চম তলায় বেসরকারি সংস্থা ইডাফ ফাউন্ডেশনের কার্যালয়। প্রতিষ্ঠানটি মূলত স্বল্পসুদে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার নামে লোকজনকে আকৃষ্ট করে। আগ্রহীদের দিয়ে ফাউন্ডেশনের নির্ধারিত আবেদন ফরম পূরণ করিয়ে নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ৩০০ টাকা দামের নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তি করে প্রত্যেক ঋণপ্রত্যাশীর কাছ থেকে ৫৭ থেকে ৯৬টি চেক স্বাক্ষর করিয়ে নেয় কর্তৃপক্ষ। ঋণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নামে নেওয়া হয় নানা অঙ্কের সার্ভিস ফি বা কমিশন। তবে ওই পর্যন্তই, কেউ আর ঋণ পাননি। এভাবে প্রায় তিন বছর ধরে প্রতারণামূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল ইডাফ। প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ তাদের ফাঁদে পড়েছেন।
ভুক্তভোগী উজ্জ্বল হোসেন বলেন, ঋণ না পেয়ে ক্ষুব্ধ লোকজনকে শান্ত করতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে নতুন কৌশল নেন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি ভুক্তভোগীদের মধ্যে ২৭৪ জনকে অনুমোদিত ঋণের একাংশ দেওয়ার নামে ১০০ কোটিরও বেশি টাকার চেক ইস্যু করেন। ৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে চেকগুলো দিয়ে টাকা তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়। সেই সঙ্গে পরের এক মাসে অবশিষ্ট টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু চেক ইস্যুর পর সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো টাকাই পাননি ভুক্তভোগীরা। কারণ চেক দেওয়া হলেও সংশ্নিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোয় কোনো টাকা ছিল না। ইডাফ ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্ট ছাড়াও চেয়ারম্যান তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের চেকও অনেককে দিয়েছেন।
ভুক্তভোগী মোমেন আল ফারুক বলেন, আমাকে ২০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে ঋণের অর্থ ছাড় করানোর জন্য ২০ লাখ টাকা চায়। আমি বহু কষ্টে স্বর্ণ বন্ধক রেখে তাদের ৬ লাখ টাকা দিই। সেই টাকাও আর ফেরত পাইনি। মাঝে দুই কোটি টাকার একটি চেক দিয়েছিল; কিন্তু সংশ্নিষ্ট অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় চেক ডিজঅনার হয়। তাদের মাধ্যমে প্রতারিত আড়াই হাজার ভুক্তভোগীর তথ্য আমরা পেয়েছি, তবে প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হবে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সনদ ছাড়া ক্ষুদ্র ঋণ সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম পরিচালনা দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ ইডাফ ফাউন্ডেশনের এ সংক্রান্ত কোনো সনদ নেই। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে না। ইডাফের এই সনদও নেই, যা আইনত অপরাধ। তা ছাড়া বৈদেশিক অনুদানের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম চালাতে হলে এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোতে নিবন্ধিত হতে হয়। ইডাফের সেই নিবন্ধনও নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থা হিসেবেও তাদের নিবন্ধন নেই। অর্থাৎ ক্ষুদ্র, মাঝারি বা বৃহৎ ঋণ প্রকল্প, বিনিয়োগ প্রকল্প পরিচালনা এবং বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার কোনো আইনগত বৈধতা ইডাফের নেই। এমনকি ঋণ দেওয়ার মতো কোনো তহবিলও নেই। অথচ দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা ঋণ দেওয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে আসছিল।
ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন কর্মকর্তার দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন এক ভুক্তভোগী। ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি কাজী সাহান হক বলেন, ঋণ দেওয়ার নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ইডাফ ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর ভিত্তিতে মঙ্গলবার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জান্নাতুল ফেরদৌস, তাঁর সহযোগী খলিলুর রহমান ও শহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পরদিন জান্নাতুলকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অভিযুক্ত অন্যদের গ্রেপ্তারেরও চেষ্টা চলছে।