করোনাভাইরাসের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশের সোয়া কোটি উদ্যোক্তা। স্বাধীনতা দিবস ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দেশজুড়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা যেসব পণ্য তৈরি করেছিলেন, এবার তার ছিটেফোঁটাও বিক্রি হয়নি। সব পণ্য অবিক্রীত রয়ে গেছে। বৈশাখের পোশাক, গ্রামের হালখাতা, মিষ্টি-দই, ইলিশ, ফুল বাণিজ্য—এবার সব আয়োজন মাটি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ এপ্রিল ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন।
এর বাইরে নিম্ন আয়ের পেশাজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য আলাদা তিন হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সোয়া কোটি উদ্যোক্তার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এই ২৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ কিভাবে বিতরণ হবে তা নিয়ে আলাদা দুটি নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু নীতিমালার বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে খোদ সরকারি দপ্তর থেকেই। শিল্প মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, এসএমই ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে বলা হয়েছে, ঋণ বিতরণের শর্ত আরো শিথিল করতে হবে। নীতিমালায় মোট ঋণের মাত্র ১৫ শতাংশ গ্রামে বিতরণের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় এটি খুবই কম। নীতিমালায় অনেক অস্পষ্টতা রয়েছে।
নীতিমালার কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন আনা জরুরি, এরই মধ্যে তা লিখিত আকারে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়েছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও নীতিমালা সংশোধনের ইঙ্গিত মিলেছে।
জানতে চাইলে শিল্পসচিব আবদুল হালিম বলেন, ‘সাধারণত যেকোনো দুর্যোগে তড়িঘড়ি করে নীতিমালা করা হয়। যদিও পরে তা সংশোধনের সুযোগ থাকে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য দ্রুত নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এই নীতিমালায় কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কোথায় কোথায় সংশোধন আনা দরকার আমরা সেসব বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছি। তারাও সংশোধনের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। আশা করছি শিগগিরই একটা সুরাহা হবে।’ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে উজ্জীবিত করতে গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা একটি নীতিমালায় মোট ঋণের ১৫ শতাংশ গ্রামে বিতরণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয় বলছে, মোট তহবিলের ৫০ শতাংশ যাতে ঢাকার বাইরের উদ্যোক্তারা পান, সে বিষয়ে নীতিমালায় স্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। মোট তহবিলের ৫০ শতাংশ কেন ঢাকার বাইরে বিতরণ করা জরুরি তার যুক্তি তুলে ধরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গ্রামীণ অর্থনীতির যে চাঙ্গা ভাব এসেছিল, তা হয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের হাত ধরে। দেশজুড়ে ৭০টির বেশি শিল্পনগরী রয়েছে। এর বাইরেও নতুন অনেক উদ্যোক্তা আছেন দেশজুড়ে, যাঁরা নিজেদের পুঁজি কিংবা আত্মীয়-স্বজন থেকে ঋণ করে ব্যবসা শুরু করেছেন। ব্যাংক থেকে এখনো ঋণ পাননি। করোনার প্রভাবে তাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাই নীতিমালায় ঋণের ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের মোট এসএমইর ৭০ শতাংশই হলো গ্রামে। গ্রামে মোট ঋণের মাত্র ১৫ শতাংশ বিতরণের যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা চাহিদার আলোকে খুবই কম। আমরা এটি বাড়াতে বলেছি। এ ছাড়া গ্রামের অনেক ছোট ছোট উদ্যোক্তা আছেন, যাঁদের ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে অনাগ্রহ রয়েছে। ব্যাংক নিয়ে তাঁদের ভীতি ও নিষ্ক্রিয়তাও রয়েছে। নীতিমালায় বলা আছে, ঋণ বিতরণ হবে ব্যাংকার-গ্রাহকের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের তো ব্যাংকে যাতায়াতই
নেই, সম্পর্ক হবে কিভাবে? ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে গ্রামের যাঁরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাঁদের ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, আবেদনকারী উদ্যোক্তা করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন—এই বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে তফসিলি ব্যাংক নিজস্ব ঋণ বিতরণ নীতিমালার আওতায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ অনুমোদন করবে। এ ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান অগ্রাধিকার পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করে এসএমই ফাউন্ডেশন বলেছে, কোন বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা চিহ্নিত হবে তা নীতিমালায় স্পষ্ট নয়। ফলে এটি সম্পূর্ণ ব্যাংকের ওপর নির্ভর করবে। এতে করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা ঋণ বিতরণ থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। যেসব উদ্যোক্তা কখনো ব্যাংক থেকে ঋণ নেননি, তাদের সঙ্গে ব্যাংকের কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এসব উদ্যোক্তাকে কিভাবে ঋণের আওতায় আনা যায়, তা নীতিমালায় অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছে এসএমই ফাউন্ডেশন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য মোট ঋণের ন্যূনতম ৫ শতাংশ বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব জানিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় বলেছে, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য মোট ঋণের ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বিতরণ করতে হবে। এ ছাড়া এই অনুচ্ছেদে শুধু নারী উদ্যোক্তাদের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, প্রতিবন্ধী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ নেই। নারী উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি নীতিমালায় পিছিয়ে পড়াদের কথা উল্লেখ করার প্রস্তাব করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। সংসদ সদস্য সেলিমা আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় নারী উদ্যোক্তাদের বিষয়ে অস্বচ্ছতা আছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় মোট ঋণের ৭০ শতাংশ কুটির ও ক্ষুদ্রশিল্প খাতে বিতরণের কথা বলা হয়েছে। ঋণের বাকি ৩০ শতাংশ মাঝারি শিল্প খাতে বিতরণের কথা বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এই অনুচ্ছেদ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, মোট ঋণের ৩০ শতাংশ মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ৩০ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ মাইক্রো ও কুটির উদ্যোক্তাদের জন্য সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোক্তাদের গত এক বছরের উৎপাদন, বিক্রি ও টার্নওভারের লিখিত হিসাব থাকা সাপেক্ষে ঋণ দেওয়া হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে। কিন্তু এই শর্ত সংশোধনের প্রস্তাব করে শিল্প মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোক্তা সাধারণত দৈনন্দিন ব্যবসার হিসাব রাখেন না। এ কারণে তাঁদের আর্থিক বিবরণ থাকার কথা নয়। ফলে নীতিমালার এই শর্তটি উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াবে। তাই এই শর্তটি শিথিলের প্রস্তাব করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, প্রান্তিক মানুষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য তিন হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আলাদা একটি নীতিমালায় বলা হয়েছে, এই ঋণ বিতরণ করা হবে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) থেকে সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই অনুচ্ছেদ নিয়ে নিজেদের আপত্তির কথা জানিয়েছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। তারা জানিয়েছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং প্রান্তিক মানুষের জন্য ঋণ বিতরণে এমআরএর বাইরে সরকারি আরো অনেক শক্তিশালী সংস্থা আছে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মতো সরকারি সংস্থা রয়েছে। তৃণমূলে এক থেকে দেড় কোটি পরিবার এসব সংস্থার সঙ্গে জড়িত। শুধু এমআরএর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সরকারি এসব সংস্থাকে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে প্রস্তাব দিয়েছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ।