প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি ও পরিকল্পনাহীনতার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেখানে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমছে, বাংলাদেশে উল্টো বাড়ছে। জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না। করোনা মোকাবেলায় দেশে ঐক্যবদ্ধ এবং সম্মিলিত কোনো কাজ হচ্ছে না। ফলে করোনা সংক্রমণের হারও কমছে না। গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠ ও কেয়ার বাংলাদেশ আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনায় জনপ্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন। তাঁরা বলেন, সরকার করোনা মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই টাকা কারা নজরদারি করবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। ফলে প্রণোদনার প্যাকেজ বাস্তবায়ন নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে এত বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কেন অনলাইনে ভ্যাট কার্যকর করা যায়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদরা। করোনার কারণে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, তাদের দ্রুত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করারও তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
কালের কণ্ঠ সম্পাদক এবং ইডাব্লিউএমজিএল পরিচালক ইমদাদুল হক মিলনের সঞ্চালনায় ‘কভিড-১৯ জনিত আর্থ-সামাজিক ঝুঁকি থেকে উত্তরণ : অর্থায়ন ও নীতিকৌশল’ শিরোনামে গতকালের অনলাইন আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, নাহিম রাজ্জাক, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন কেয়ার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রমেশ সিং। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক আমানুর রহমান।
ইমদাদুল হক মিলন বলেন, করোনায় দেশের অর্থনীতি এলোমেলো হয়ে গেছে। রাজস্ব আয়, আমদানি, রপ্তানি, প্রবাসী আয়সহ অর্থনীতির সব সূচকই স্থবির। করোনার প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়ছে মানুষ। প্রতিদিন চাকরি হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। করোনার কারণে অনেক পেশা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। শহর ছেড়ে গ্রামমুখী মানুষের স্রোত বাড়ছে। করোনার প্রভাবে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে। নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে এক কোটি ৬৩ লাখ মানুষ।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘সামাজিক সুরক্ষা খাতে সরকার বরাদ্দ বাড়িয়েছে। তবে সামাজিক সুরক্ষা খাতে সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন নিয়ে অনেকে সমালোচনা করছেন। আমিও মনে করি, সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশনের টাকা সামাজিক সুরক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক নয়। আলাদা করা দরকার। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ আরো বাড়ানো দরকার।’
সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ কমানোর জন্য এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা দেখতে পারছি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে আমাদের সতর্ক করা হয়েছিল; কিন্তু আমরা ঠিক করতে পারিনি করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা কোন হাসপাতালে হবে। জনপ্রতিনিধি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক শক্তিসহ সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া করোনা মোকাবেলা সম্ভব নয়।’
নাহিম রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকিং খাতে জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার দরকার। সরকার এক লাখ কোটি টাকার বেশি ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই টাকার নজরদারি কারা করবে তার কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। করোনা মোকাবেলায় গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে। এসব বিষয়ে সরকারকে সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা দিতে হবে।’
সমাজকল্যাণ সচিব বলেন, ‘আমরা কেউ জানি না করোনা কবে নাগাদ বিদায় নেবে। তাই বলে আমরা বসে নেই। করোনার কারণে আমরা সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছি। সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো হয়েছে।’
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেন, বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার আজও হয়নি। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর কোনো বিকল্প নেই।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘করোনার কারণে সারা বিশ্বেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। অথচ আমাদের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে উচ্চাভিলাষী, ৮.২ শতাংশ।’ ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাইলে যে হারে বিনিয়োগ হওয়া দরকার, তা হবে না বলে জানান তিনি।
স্বাগত বক্তব্যে কেয়ার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রমেশ সিং বলেন, করোনা মোকাবেলায় সরকার এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ৫০ লাখ পরিবারকে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ঘোষণা সত্যি প্রশংসনীয়। তবে দীর্ঘ মেয়াদে করোনা মোকাবেলা করতে হলে সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়াতে হবে।
মূল প্রবন্ধে আমানুর রহমান বলেন, কডিভ-১৯-এর কারণে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে। এখন পর্যন্ত এক কোটি ৬৩ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তিন কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৫০ কোটি ডলার সমপরিমাণ রপ্তানির ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। ১৩ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। করোনা মোকাবেলায় সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, মানুষের জীবন-জীবিকা ও করছাড়ে বিশেষ মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।