‘আমি দাদাভাই বাহিনীর লোক বলছি। ১০ লাখ টাকা দিতে হবে। চালাকি করলে তোকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। … থানায় আমার লোক আছে। থানায় গেলে সঙ্গে সঙ্গেই আমার কাছে খবর চলে আসবে।
তখন কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না।’ এভাবেই রাজধানীর কারওয়ান বাজারের এক ব্যবসায়ীর কাছে টাকা চান ‘দাদাভাই বাহিনী’র এক সদস্য। টাকা না দেয়ায় পরে তাকে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা।
এমন দুটি ঘটনার পর এ বাহিনীর দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মো. মামুন ও মামুন পাটোয়ারী নামের ওই দু’জনকে বৃহস্পতিবার আদালতে তোলা হলে বিচারক তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
তবে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বলছে, আবারও তাদের রিমান্ড আবেদন জানানো হবে। ডিবি বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, ছিনতাই করা সেট-সিম দিয়ে চাঁদা দাবি করা হয়। না পেলে কুপিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেয় তারা। এমনকি কোপানোর পরও টাকা চাওয়া থেকে সরে আসে না। এ চক্রের ১২ সদস্যকে এখন খুঁজছে পুলিশ।
জুলাইয়ের শুরুতে উত্তর কারওয়ান বাজারের ফলপট্টির ব্যবসায়ী গোলাম সারোয়ার বিপ্লব এমন ফোন পেয়ে টাকা দিতে অপারগতা জানান। এর ৫৫ দিন পর ২৪ আগস্ট তাকে ফলপট্টিতে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তার কাছে থাকা সাড়ে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় জানিয়ে যায়, দাদাভাইয়ের কথা না শোনার এটাই পরিণাম। এ ঘটনায় পরদিন বিপ্লব তেজগাঁও থানায় মামলা করেন।
এর রেশ না কাটতেই সেপ্টেম্বরের শুরুতে সামসুল আলম নামের তেজতুরী বাজার এলাকার এক ঢেউটিন ব্যবসায়ীর মোবাইলে ফোন করে ১০ লাখ টাকা চায় ‘দাদাবাহিনী’।
তিনি না দিতে চাইলে ৮ সেপ্টেম্বর তাকে কুপিয়ে কাছে থাকা ২৩ হাজার টাকা নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। যাওয়ার সময় সামসুল আলমকেও একই কথা শুনিয়ে যায়। এ নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর মামলা করেন সামসুল আলম।
বিপ্লব যুগান্তরকে বলেন, প্রথম ফোন পেয়ে ধারণা করছিলাম কেউ হয়তো মজা করে ফোন করেছেন। আর ফোন না আসায় পুলিশকেও জানাইনি।
এরপর একদিন আমার কলার আড়তের সামনে হঠাৎ ৪-৫ যুবক ঘিরে ধরে আমাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এতে আমি মারাত্মক আহত হই। আমি সুস্থ হওয়ার আগেই আবারও ফোন আসে। এবার পাঁচ লাখ টাকা চায়। আমি বলি, আমার দুই হাতের রগ কাটা গেছে।
এখনও সুস্থ হইনি। আগে সুস্থ হই। পরে টাকা দেব। তখন তারা আমাকে বলে, ‘তোর সুস্থ হওয়ার দরকার নেই। তুই ৫ লাখ টাকা না দিলে তোকে আমরাই পরপারে পাঠিয়ে দেব।’
ব্যবসায়ী সামসুল আলম বলেন, দাদাভাই নামে কারওয়ান বাজার বা ঢাকায় কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ আছে বলে কখনও শুনিনি। এ কারণে প্রথমে ফোন কলকে পাত্তা দিইনি। এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়।
অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই দৃশ্য এখনও চোখে ভেসে ওঠে। তিনি বলেন, দুই ঘটনার পর কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে ‘দাদাভাই বাহিনী’ আতঙ্কের নাম।
দাদাবাহিনীর চাঁদা দাবির কয়েকটি রেকর্ড যুগান্তরের হাতেও এসেছে। এতে এমনও শোনা গেছে, ‘তেজগাঁও থানায় ওসি যিনিই আসুক না কেন তাকে আমার কথায় চলতে হবে।
আগের ওসিও শুনেছে। এখন যিনি এসেছেন তিনি নতুন, তাই বুঝতে পারছেন না। কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারবেন; নাহলে তাকে বান্দরবানের পথ ধরতে হবে।’
দুই ব্যবসায়ীর মামলাতেই আসামি অজ্ঞাত। তদন্তে নামে পুলিশ। ছায়া তদন্ত শুরু করে ডিবি। ডিবির কয়েকজন সদস্য গোপনে কথা বলেন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। এতে সাহস পেয়ে মুখ খুলতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, এমন ফোন পেয়ে কয়েক মাসে অনেকেই গোপনে টাকা দিয়েছেন।
তদন্তে নেমে স্থানীয় দুটি গ্রুপের বিষয়ে খোঁজ নেয়া শুরু করে পুলিশ। কিন্তু দেখা যায়, তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এরপর হুমকি দেয়া মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে অপরাধীদের সন্ধানে নামা হয়। দেখা যায়, ফোনটি মেহেদী নামে এক ব্যক্তির।
পুলিশ তাকে আটক করে। মেহেদী জানান, তার মোবাইল ফোনটি সেন্ট্রাল রোড থেকে ছিনতাই হয়। পরে পুলিশ ছিনতাইয়ে জড়িত মামুন, সুমন ও মজিদ নামে তিনজনকে শনাক্ত করে। গ্রেফতার করা হয় মামুন ও মামুন পাটোয়ারীকে। মামুনের বাড়ি ময়মনসিংহের ইশ্বরগঞ্জে এবং পাটোয়ারীর বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ (ডিসি) কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মামুন ও মামুন পাটোয়ারীও দাদাভাইকে চেনেন না বলে দাবি করে।
অজ্ঞাত স্থান থেকে আসা ‘দাদাভাইয়ের’ নির্দেশে তারা কাজ করেন বলে জানায়। তবে তদন্তে সেই দাদাভাই ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের সন্ধান পাওয়া গেছে। দ্রুতই তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে।
ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহাদাত হোসেন সোমা জানান, বিভিন্ন স্থান থেকে ছিনতাই করা ফোন এবং সিম থেকে কারওয়ান বাজার এলাকায় ব্যবসায়ীদের হুমকি এবং চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে টাকা আদায় করত মামুন, মামুন পাটোয়ারী, রিপন, সুমন ও মজিদ।
এদের মধ্যে ২০০৯ সালে কারওয়ান বাজারের কাঠপট্টিতে দিনের বেলায় গুলি করে তিনজনকে হত্যা মামলার প্রধান আসামি হচ্ছে মামুন, রিপন ও সুমন। তাদের নামে তেজগাঁও বিভাগের বিভিন্ন থানায় হত্যা, চাঁদাবাজি ও মাদকের মামলা রয়েছে।