ডেইলি খবর ডেস্ক: দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও গুরুত্বপূর্ন শহরাঞলে গ্যাং কালচার এখন আলোচনায়। বিশেষ করে রাজধানীর ঢাকার বিভিন্ন অলি-গলিতে এখন টোকাইদের নেতৃত্বে ‘গ্যাং কালচারে’ জড়িয়ে পড়েছে অভিজাত পরিবারের সন্তানরাও। র্যাবের অব্যাহত অভিযানে মাঝেমধ্যেই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা গ্রেপ্তার হচ্ছে, আবার জামিনে বেরিয়ে এসে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর গ্যাংয়ের বেশির ভাগ সদস্য অভিজাত পরিবারের সদস্য হওয়ায় তারা দ্রুত জামিন পেয়ে যায়।
বিভিন্ন সূত্র জানায়,কিশোর গ্যাংয়ে একাধিক কিশোরীও রয়েছে। এদের দিয়ে ফাঁদে ফেলা হয় বিত্তবান ব্যবসায়ীদের। ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় করা হয়। আবার বিত্তবান পরিবারের মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাদের দিয়ে নির্মাণ করা হয় পর্ন ভিডিও। সেগুলো পরিবারের কাছে পাঠিয়ে টাকা আদায় করা হয়।
মূলত মাদকের বিস্তার ঘটাতেই উত্তরায় গড়ে তোলা হয় এসব গ্রুপ। সেখানে প্রথম কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান ঘটে ২০০১ সালে। টঙ্গীর বউবাজার এলাকার টোকাই রহিমের হাত ধরে, যে মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এরপর প্রায় ১২ বছরে ৩০টির মতো কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে। ২০১২ সালে এসে বিভিন্ন গ্রুপ নাইন স্টার ও ডিসকো বয়েজ নামে সক্রিয় হয়। স্থানীয় বাসিন্দা, কয়েকজন সাংবাদিক, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, আদাবর,শ্যামলী, হাজারীবাগ, টিকাটুলি,মতিঝিল কলোনী, লালবাগ ও উত্তরার একাধিক সুত্র জানিয়েছেন, কিশোর গ্যাংগুলো এখন রাজনৈতিক নেতাদের আশকারা পেয়ে এসব উঠতি বযসি কিশোর-কিশোরীরা বেপরোয়া হয়ে গ্যাং কালচাওে জড়িয়ে নানা অপরাধা ও হত্যাকােেন্ডও জড়িয়েছে।
সম্প্রতি ‘টিকটক’ ও ‘লাইকি’ তারকা হিসেবে ইয়াসীর আরাফাত অপু এক পথচারীকে মারধর করে আটক হয়েছে। এরপর পুলিশ বলেছে, অপু ও তার সঙ্গীরা কিশোর গ্যাং হিসেবে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা চালাচ্ছিল। এসব এলাকা ঘুরে জানা যায়, র্যাব-পুলিশের তৎপরতার পরও এখন উত্তরা-হাজারীবাগ এলাকায় সক্রিয় রয়েছে একাধিক কিশোর গ্যাং। এর মধ্যে রয়েছে নাইন স্টার গ্রুপ, ডিসকো গ্রুপ, ফিফটিন গ্রুপ, আলতাফ গ্রুপ ও সুজন গ্রুপ। তুরাগ এলাকায় ডন বসকো গ্রুপ নামের আরেকটি নতুন গ্যাং হয়েছে। এই গ্রুপের এক সদস্য আদনান কবীর হত্যা মামলার ২৯ নম্বর আসামি। একসময়ে ছিল পেশাদার চোর। এখনো অস্তিত্ব রয়েছে রহিম গ্রুপের। এ ছাড়া রয়েছে নাইন স্টার এমএম ও কাকড়া গ্রুপ।
এরআগে ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আদনান কবীর হত্যাকান্ডের পর আলোচনায় আসে উত্তরার কিশোর ‘গ্যাং কালচার’। নড়েচড়ে বসেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। আদনান হত্যার সঙ্গে জড়িতরা ছাড়াও বিভিন্ন গ্রুপের একাধিক দলনেতা ও সদস্য র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়। ওই সময় ডিসকো বয়েজ, বিগ বস ও নাইন স্টার গ্রুপের নাম বেশ আলোচিত হয়।
নাইন স্টার গ্রুপের নেতা হয় তালাচাবি রাজু এবং ডিসকো বয়েজ গ্রুপের নেতা তারকাটা বাবু। রাজু তার বাবার সঙ্গে ফুটপাতে বসে তালাচাবি মেরামতের কাজ করত বলে গ্রুপটি ‘তালাচাবি’ নামেও পরিচিত ছিল। অন্যদিকে একবার বাবু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর তাকে তারকাটা দিয়ে পেটানো হয় বলে সে পরিচিত হয়ে ওঠে তারকাটা বাবু নামে। তার নেতৃত্বে চলে নাইট গ্রুপ।
উত্তরার মাইলস্টোন, উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নবাব হাবিবুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী অভিজাত পরিবারের বখাটে সন্তানদের দলে টানে কিশোর গ্যাং। প্রযুক্তির প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে। পরিবারের অসচেতনতার কারণে অভিজাত পরিবারের সন্তানরা ‘রবিনহুড’ সাজার জন্য ভিড়ে যায় গ্যাংয়ে।
দলবেঁধে বাঁশি বাজিয়ে মোটরসাইকেলের মহড়া দেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন ও মাদক বিক্রি করা, আধিপত্য বজায় রাখতে খুনখারাবি, মারামারি করার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এসব গ্রুপের সদস্যরা। জানা যায়, অবাধে মাদক সেবন ও আড্ডা দিতে গড়ে তোলে ডান্স ক্লাবও। ডন বসকো নামের একটি গ্রুপ এমন একটি ডান্স ক্লাব গড়ে তোলে তুরাগ এলাকায়। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ডান্স শেখার আড়ালে চলে এদের মাদক সেবন। র্যাবের অভিযানে মাঝেমধ্যে ক্লাব বন্ধ থাকে। আবার গোপনে এরা চালু করে। গত ১০ জুলাই উত্তরার আজমপুর এলাকায় একজন কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে বিরোধের জের ধরে পিটিয়ে দৈনিক জনতার সাংবাদিক খোকনের কোমর ভেঙে দেওয়া হয়। খোকনকে যারা মারধর করে তাদের একজন ডিসকো গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য। এর আগে এরা উত্তরার আরেকজন সংবাদকর্মীকেও মেরে পা ভেঙে দেয় ওই রাজনৈতিক নেতার নির্দেশে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মাদ শরিফুর ররমান বলেন,অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে পরিবারের অজান্তেই তাদের সন্তানরা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়েছে। প্রথমদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এদিকে নজর দেয়নি। তত দিনে বড় ধরনের সর্বনাশ হয়ে গেছে। তবে এখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় গ্যাংগুলো অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আছে। খোজ নিয়ে জানা গেছে করোনাপরিস্থিতিতে এসব গ্যাং সদস্যরা সন্ধার পরেই বিভিন্ন অলিগলিতে সংঘবদ্ধ হয়ে আড্ডা ও পরিকল্পনা করে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে।