নাজমুল হোসেন: কায়সার আলী, পেশায় কৃষক। পাঁচ ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বাড়িতে থাকেন দুই ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে। সাদাসিধে মানুষ কায়সার আলী ধর্মভীরু ও পরোপকারী। দেশে বর্তমানে মারণভাইরাস করোনার জন্য লকডাউন চললেও সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই কায়সার আলির। তবে এতে যে তিনি যথেষ্ট বিরক্ত সেটা তার বয়ানেই স্পষ্ট। তবে বিরক্ত প্রকাশ করার যুক্তিগত কারণও আছে।
কায়সার আলীর ভাষ্য, আমরা ছোটকাল থেকেই রোগ ব্যাধিসহ জনাকীর্ণ পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হয়েছি। এখন নতুন রোগ আসছে, আগেও এরকম বিভিন্ন রোগ ছিলো। তখনও আল্লাহ রক্ষা করেছে, এখনো তিনিই দেখবেন।
কায়সার আলীর মত দেশের লাখ লাখ মানুষ রয়েছে যাদের চিন্তা-চেতনা ভিন্ন হলেও মূল দৃষ্টিভঙ্গি একই ‘ঘরে বন্দি থাকা যাবে না’। বিভিন্ন বাহানায় তারা বাইরে যাবেনই।
আচ্ছা, কেন বন্দি থাকা যাবে না এটাও খোঁজা দরকার। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কেনই বা অবাধ্য?
এর প্রধান একটা কারণ হতে পারে আমাদের কথা ও কাজে মিল খুবই কম। আমরা জনগণকে ঠিকঠাক বুঝাতে পারিনি রাষ্ট্রের আইন মানাটা বাধ্যতামূলক। তবে, হ্যা জেল জরিমানা জারি থাকলেও সেটাও জায়গামত প্রয়োগ হচ্ছে না। না হলে, মফস্বলের লোকজন কীভাবে বলে, ‘কই আমরা তো সারাদিনই বাইরে থাকি, কোনো পুলিশ তো দৌঁড়ানি দেই নি, আর আপনারা কী বুঝান’। তাকে যখন বুঝানো হয়, ‘ভাই এটা তো আপনার ভালোর জন্য, আপনি ঘরে না থাকলে রোগটা ছড়াবে এবং ঘরে থাকাটাও নিজ দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’
জবাবে তার স্পষ্ট প্রতিবাদী উত্তর, ‘খাওন দিবে কে, আমাদের তো সংসার আছে, পেট আছে। চলবে কীভাবে? সরকারের ত্রাণ আমাদের কাছে পৌঁছায় না।’
লোকের কথার প্রমাণও মেলে দেশে ঘটা সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে। যেখানে দরিদ্র লোকদের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণ রাঘব বোয়ালরা হজম করতে পারে, সেদেশে বৃহৎ দরিদ্র গোষ্ঠীকে রাখবেন কিভাবে? আর এহেন কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জড়িত থাকতে দেখা গেছে যা গণমাধ্যমে প্রকাশও হয়েছে। এছাড়া সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ভুলভাল বক্তব্যও আছেই।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জড়িত থাকা ও আমজনতা কেন ঘরবন্দি নয়, বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করেছিলাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাবেক পরিবেশ বিষয়ক উপ-সম্পাদক ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী সজীবের সঙ্গে।
তার ভাষ্য, যেহেতু এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি সেক্ষেত্রে সচেতনতাই একমাত্র উপায়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, মফস্বলের মানুষের মধ্যে সচেতন থাকার প্রবণতা একদমই কম। এর অন্যতম কারণ, এ রোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামি আঁকড়ে ধরে কুসংস্কার চর্চা। আর রাজনৈতিক নেতাদের ত্রাণ চুরির যে ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে এসেছে তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। আর আমি তাদেরকে রাজনৈতিক নেতা বলতে নারাজ। তারা রাজনীতির লেবাস পরে ফায়দা লোটা সুবিধাভোগী। প্রকৃত আদর্শবান রাজনৈতিক কর্মী কখনো এ ধরনের হীন কাজ করতে পারে না। এর জন্য যে কোনো দল, সংগঠন বিতর্কিত হয়।
তবে বিষয়টি সরকারের নজরে আসার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তাৎক্ষণিক নির্দেশনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে তা প্রশংসার দাবি রাখে। এ ধরনের লুটেরাদের ব্যাপারে আইনানুগ ও দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করায় চোরদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। লুটপাট অনেংকাশেই কমে এসেছে- যোগ করেন সজীব।
এত গেলো গরিবের অভিযোগ ও গুটিকয়েক রাজনৈতিক নেতাদের কর্মকাণ্ড। বাকিরা? তারা কি সচেতন? জি, তাদের সচেতনতার লেবেলটা আবার ভিন্ন। কায়দাকানুনে তারা দরিদ্রদের চেয়েও অসচেতন।
যার প্রমাণ মেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঢুঁ মারলে। ত্রাণ দেয়ার নামেও দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে প্রচারণা। শো অফ হলেও অনেকে বিষয়টাকে বাহবা দিচ্ছে। তাদের যুক্তি, একজনকে দেখে হলেও অন্যরা শিখবে। সেটাতেও সমস্যা ছিলো না, তবে ত্রাণের নামে লোক জমায়েত বা নির্দিষ্ট দূরত্ব না মানা, এছাড়া ফটোসেশনের নামে প্রতিযোগিতা এগুলো ফেসবুকে অহরহ প্রচার হচ্ছে। অনেকে আবার চেহারা ব্লার করেও ছবি প্রচার করছে। মূল উদ্দেশ্য, প্রচার লাগবেই। তাহলে কি নিয়ম মানা হচ্ছে?
এছাড়া বিভিন্নস্থানে যারা সাধারণ মানুষদের সচেতন করছেন সেখানেও একপ্রকার জটলা পাকানো হচ্ছে। এরকমও দেখা গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক জায়গায় গাছের গুড়ি ফেলে বা অন্যান্য উপায়ে লকডাউন করা হয়েছে। সেখানেও মানুষের জমায়েত লক্ষ্য করা গেছে। সরকার আপনাদের ঘরে থাকতে বলেছে, রাস্তা বন্ধ করতে নয়। এটাও মাথায় রাখতে হবে, রাস্তা বন্ধের ফায়দা অসাধুরা যেকোনো সময় নিতে পারে।
এবার আসি দেশের উচ্চ মহলের বিষয়ে। হ্যা, তারাও দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সমাজের নিম্নশ্রেণিকে সাহায্যের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে যাদের মাধ্যমে করাচ্ছেন সেটার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কিনা, নজরে কি আছে তাদের?
অন্যদিকে, করোনা মহামারিতে যখন দেশে সাধারণ ছুটি চলছে তখনও কিন্তু সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ব্যাংকাররা। তারা কতটুকু নিরাপদ? যেখানে ইতোমধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তারাও আক্রান্ত হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকের কর্মচারী অনিক রহমান জানালেন সেই আতঙ্কের কথা।
তিনি বলেন, ‘দেশের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছি। মনে অজানা ভয় চেপে বসেছে। কারণ প্রতিদিন শত শত মানুষ ব্যাংকে আসছে। জানিনা কার শরীরে কী আছে। তার ওপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে আসতে হয়। সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, ভালো। আগে তো বাঁচতে হবে? অন্যদিকে দেশের মানুষ খামখেয়ালিভাবে দেখছে বিষয়টাকে। তারা বাইরে ঘুরছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের উন্নয়নের চাকা রসাতলে যাবে। সরকারের উচিত কঠোর হওয়া, বিশেষ করে মফস্বলে।’
আমরা আসলে গুজব রটানো বাঙালি। দেশটা পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ গুজব। যেখানে সরকার চাইছে একজনও না মরুক, আমরা চাইছি মৃত্যুর মিছিল লাগাতে। গত ৪০ দিনের আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ ঘাঁটলেই সেটা স্পষ্ট। করোনায় মৃত্যুর হারে পৃথিবীতে সবার প্রথমে আমরা। যেখানে সংক্রমণ বেশি, সুস্থতা কম।
এদেশের প্রেক্ষাপটে এমন চিত্রও দেখা গেছে। প্রবাসী ফিরে এসে ঘুষ দিয়ে পালিয়ে গেছে। এছাড়া কোয়ারেন্টাইনে থাকতে চাচ্ছে না। উল্টো দেশকে গালিগালাজ করছে। অথচ এই ব্যক্তিটাই প্রবাস জীবনে সে দেশের আইনকানুন অক্ষরে অক্ষরে মেনে এসেছে। তাহলে আমাদের ভুলটা কোথায়! আমাদের টপ টু বটম স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে হয়তো!
ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করেন ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ বিন সালেহ্। কাজ করতে গিয়ে মিশেছেন দেশের বাইরের ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম অন্য দেশের কর্মীরা এদেশের আইন কেমন মানেন? এছাড়া এদেশের প্রবাসীরা কেন ফিরে এসে আইন মানেন না?
সালেহ্ জানান, ‘বিদেশি কর্মীরা খুবই পাংচুয়াল। তারা কাজ ও আইনের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। কারণ এটা তারা ছোট থেকেই মেনে আসছেন। যেটা তারা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক, মেনে চলেন। অন্যদিকে আমাদের দেশের মানুষরা দেশে ফিরে এসে আইন ভুলে যায়, তার প্রধান কারণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নাই। ইচ্ছে করলেই বিভিন্ন কারসাজিতে এদেশে আইনের ফোঁকর থেকে বের হওয়া যায়, বিশ্বাস তাদের। যেটা বাইরের দেশে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, যতদূর জানি। তাই সর্বস্তরে আইনের সঠিক প্রয়োগ লাগবে, উচ্চ থেকে নিম্ন।’
এই করোনাকালে সাধারণ জনগণের উচিত সরকারের আদেশ মেনে ঘরে থাকা। আর সরকারের উচিত তাদের ঘরে খাদ্য পৌঁছানো নিশ্চিত করা, যারা যোগ্য। আমরা তাহলেই আগের রূপে ফিরতে পারবো- যোগ করেন সালেহ্।
এত এত কথার পরও আসল কথা হলো, ঘরে থাকতে হবে। এই জাতিকে নীতিকথায় শুধরানো যাবে না। যদি না নিজ থেকে হয়।
তবে আতঙ্কের একটা বিরাট ঘাটতি রয়েছে এ দেশে। আর সেটার বাস্তবায়ন যদি বিশেষ করে মফস্বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখাতে পারে তাহলে অনেকটা সফল হবো আমরা। ধারণা, এ জাতিকে ‘লাঠি’ই পারবে ঠিক রাখতে। কিছুদিন আগেও এক র্যাব কর্মকর্তা বলেছিলেন, তাদের জনগণের সাথে ইঁদুর-বিড়াল খেলতে হচ্ছে। আমাদের আগে বুঝতে হবে, তারা আমাদের (জনগণ) সুরক্ষার জন্য কাজ করছে। আর আমরা করছি উল্টোটা, সারাদিন বাইরে ঘুরছি, তাদের দেখলেই ভোঁ দৌড় দিচ্ছি।
এ এক অদ্ভুত দেশ। ভালো মন্দ দুদিকেই সমালোচনা রয়েছে এ দেশে। নিয়মকানুন যেখানে মুখের কথাতেই সীমাবদ্ধ। রাস্তা ফাঁকা থাকলেও মানুষ বের হয়ে দেখে, কেউ আছে কিনা! সেনাবাহিনীকে দেখতে মানুষ জড়ো হয়, আবার ভয়ও পায়। যেন মঙ্গল গ্রহ থেকে ওরা এসেছে। কী অদ্ভুত!
জানাজায় মানুষের জনসমুদ্র হচ্ছে। যেখানেও যুক্তি, আমরা কি মরবো না? এত লোক জানাজায় সামিল এটা মৃত লোকের কপাল। এসব সবার ভাগ্যে জোটে না, এছাড়া আরও বহু কথা। বলা হচ্ছে, এ রোগ ধর্ম বর্ণ চেনে না। এর প্রধান ওষুধ হচ্ছে নিজের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা। সেটা না করলে পারলে ছড়িয়ে পড়বে লোক থেকে লোকালয়ে, হচ্ছেও তাই। এছাড়া খাবার বিতরণের ক্ষেত্রেও দূরত্বের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে, সেটাও মানা হচ্ছে না অনেকাংশেই।
বিষয়টি লেজে গোবরে তখনই হয়ে গেছে যখন সরকার দুদিন হাতে রেখে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিলো। ছুটি পেয়ে মানুষ যে যেভাবে পেরেছে ছুটেছে গ্রামের পথে। আবার গার্মেন্টস মালিকটা হঠাৎ কর্মীদের কাজে আসতে বলায় কিছু শ্রমিক শহরে ফিরেছে পায়ে হেঁটে। পরবর্তীতে ফের সরকারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গার্মেন্টস ছুটি দিলে আবারো তারা গ্রামে ফিরে যায়। তাতে করোনা সংক্রমণ একপ্রকার সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলা যায়। এখনো সময় আছে, আমরা নিজেরা শুধরে এ যুদ্ধে জয়ী হতে পারি।
দেশ মহাদুর্যোগের দিকে যাচ্ছে। আমরা সাধারণরা সচেতন না হলে সরকার ছুটিই শুধু বাড়াতে পারবে। ফলাফল দিনশেষে শূন্যের খাতায় থাকবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আতঙ্ক বাড়াতে হবে। যাতে জনগণ বুঝতে সক্ষম হন, নিজের জন্য ঘরে থাকতে হবে।
‘সময় ফুরিয়ে গেলে আল্লাহ নিয়ে যাবে’- এ সমস্ত কথা বাদ দিয়ে নিজের পরিবারকে সচেতন করুন, আবদ্ধ করুন। আপনি মরলে পুরো এলাকাকে সংক্রমিত করবেন, সেটাও মাথায় রাখতে হবে।
সরকারকে সহযোগিতা করুন। আপনি বাঁচলে, বাঁচবে দেশ। আবার ফিরে পাবো কোলাহলপূর্ণ সোনার বাংলাদেশ।