কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় দল। নির্বাচন কিংবা দলীয় সম্মেলন এলেই পদে না থাকা এবং কম গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাদের কদর বাড়ে। কমিটিগুলোতে নতুন নেতৃত্বের উপস্থিতি নেই। পুরনোতেই কর্র্তৃত্ব আর প্রভাবের ঘুরপাক।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কমিটিগুলো নিয়ে হতাশায় নেতাকর্মীরা। বৈশি^ক মহামারী করোনা মোকাবিলাসহ দলের সবধরনের কর্মসূচি পদে না থাকা, পদবঞ্চিত এবং কম গুরুত্বপূর্ণ পদধারীরাই সফল করে থাকেন। কিন্তু তারপরও কমিটিতে তাদের স্থান নেই বা পদোন্নতি নেই। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ও নতুন হওয়া কমিটিগুলো পূর্ণ না করায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেছেন, সময়মতো সম্মেলন না হলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয় না। আবার কোনো কোনো জায়গায় কমিটি হলেও সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকহ কয়েকজন দিয়ে চলছে। সাংগঠনিক গতি কমে যাচ্ছে। তারা মনে করেন, এভাবে বছরের পর বছর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চললে একসময় ভালো নেতৃত্বের সংকট দেখা দেবে। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন নেতৃত্বের বিকল্প নেই।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ৪২টি। ৬৫০টি সাংগঠনিক উপজেলা-থানা কমিটির মধ্যে ৪০০-এর বেশি কমিটির মেয়াদ শেষ। আবার বেশিরভাগ কমিটিই পূর্ণাঙ্গ নয়। পুরনো কমিটির নেতারাই সবকিছু করছেন। আর তৃণমূলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিশৃঙ্খলা বেড়েই চলেছে।
গত বছরের শেষের দিকে দলের সাংগঠনিক পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায় থেকে একাধিক জরিপ এবং অনুসন্ধান করা হয় তৃণমূলের দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে। এ-সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। সেই সব তথ্য সম্পর্কে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াকিবহাল। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী এবং সুযোগ সন্ধানী ঢুকে পড়ার অন্যতম কারণ হলো, সময়মতো সাংগঠনিক কমিটিগুলো না হওয়া। আওয়ামী লীগ সভাপতি তৃণমূলের অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলার কারণ ও সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছেন।
ঢাকা বিভাগে সাংগঠনিক জেলা ১৭টি। কিন্তু ঢাকা মহানগরীর পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলেও থানা-ওয়ার্ড ও ইউনিট কমিটির কোনো খবর নেই। বছরের পর বছর চলছে প্রভাবশালী নেতাদের দাপটে। এখানে চারটি মহানগরী রয়েছে ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর। বাকি ১৩ জেলা হলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী ও টাঙ্গাইল। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণ ছাড়া ১৫ সাংগঠনিক জেলা কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। এর বাইরে শতাধিক উপজেলা ও দুই শতাধিক থানার দুই-তৃতীয়াংশই মেয়াদোত্তীর্ণ।
ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই জেলা সম্মেলন শুরু করব। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা-উপজেলায় সম্মেলন করার প্রস্তুতি রয়েছে।’
১৫ সাংগঠনিক জেলা চট্টগ্রাম বিভাগে। রয়েছে ১৩ জেলা ও দুই মহানগরী। কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম মহানগরী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা উত্তর, দক্ষিণ, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান। এর মধ্যে আটটির সম্মেলন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। এ বিভাগে ১২৯ উপজেলা সমমর্যাদার শাখা কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে সম্মেলন হয়েছে ৫৯টির।
চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘এর মধ্যে আমরা বিভাগীয় প্রতিনিধি সভা করেছি। আর যেসব জেলা-উপজেলা ও থানায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে, সেখানে কাজ করা হচ্ছে। এখন আমি সাংগঠনিক কাজে কক্সবাজারে আছি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সম্মেলন শুরু করে হবে।’
রাজশাহী বিভাগে আট জেলা ও এক মহানগরী। এর মধ্যে ২১তম জাতীয় সম্মেলনের পর বগুড়া, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী এই চার মহানগরীর সম্মেলন হয়েছে। এ ছাড়া ২৭ উপজেলার সম্মেলন হয়েছে। আর চার জেলা কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। এই বিভাগে ৮৩ উপজেলার সমমর্যাদার কমিটি রয়েছে। ৫৬ উপজেলায় সম্মেলনের কাজ চলছে।
জানা গেছে, করোনার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সব জেলা, উপজেলা সম্মেলন করা হবে এবং থানা কমিটিও ডিসেম্বরের মধ্যেই করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
বরিশাল বিভাগে আওয়ামী লীগের ৭ সাংগঠনিক জেলা। সেগুলো হলো বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল মহানগরী, বরিশাল জেলা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের আগে ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও বরিশাল মহানগরীর সম্মেলন হয়েছে। এ তিন সাংগঠনিক জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটিও ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি চার জেলা কমিটি এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ।
সিলেট বিভাগে আওয়ামী লীগের পাঁচ সাংগঠনিক জেলা। সেগুলো হলো সুনামগঞ্জ, সিলেট জেলা, সিলেট মহানগরী, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। গত জাতীয় সম্মেলনের আগে সুনামগঞ্জ ছাড়া এ বিভাগের অন্য জেলাগুলোর সম্মেলন হয়েছে। এগুলোর পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়েছে। এ পাঁচ জেলার মধ্যে সিলেট জেলা, মহানগরী, মৌলভীবাজারের উপজেলাগুলোর সম্মেলন হয়েছে। তবে সুনামগঞ্জের কয়েকটি উপজেলার সম্মেলন বাকি।
সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘সিলেটের সুনামগঞ্জ ছাড়া সব জেলা ও উপজেলায় কমিটি হয়েছে। সুনামগঞ্জ বাকি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সম্মেলন করা হবে।’
ময়মনসিংহ বিভাগে আওয়ামী লীগের চার জেলা ও এক মহানগরী। সেগুলো হলো ময়মনসিংহ মহানগরী, ময়মনসিংহ জেলা, শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোনা। এর সবই বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ। একই অবস্থা বিভাগের উপজেলা, থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন কমিটিগুলোরও।
রংপুর বিভাগে আওয়ামী লীগের আট জেলা ও এক মহানগরী। মেয়াদোত্তীর্ণ গাইবান্ধা, দিনাজপুর ও পঞ্চগড় জেলা কমিটি। খুলনা বিভাগে আওয়ামী লীগের ১১ সাংগঠনিক জেলা। মেয়াদোত্তীর্ণ চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। অনেক উপজেলার সম্মেলন বাকি।
কেন্দ্রীয় নেতারা জানিয়েছেন, এ বছরের জানুয়ারিতেই শেখ হাসিনা সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশ দেন এবং আগামী সম্মেলনের আগে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি দেওয়ার বিষয়েও নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর থেকেই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ বাড়ে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জেলা-উপজেলা নেতাদের কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠান। এর মধ্যে করোনাও কিছুটা কমে আসে। ফেব্রুয়ারিতে উপজেলা সম্মেলন শুরু হয়। প্রথমেই রাজশাহী বিভাগের ২৭ উপজেলার সম্মেলন শেষ হয়। ঢাকা বিভাগেও সম্মেলন হয়। সেই সময় সময় নির্ধারণ করা হয়, এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জেলার সম্মেলন শেষ করার। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সব বন্ধ।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বেশি। নতুন ও যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করা এই দলের ঐতিহ্য। বছরের শুরুতেই সম্মেলন করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে অনেক জায়গায় দিনক্ষণ নির্ধারণ করেও আগানো সম্ভব হয়নি। তবে করোনার প্রকোপ কমলে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করা হবে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।