করোনাকালে সড়ক-মহাসড়কে বেড়েছে ছোট গাড়ির ব্যবহার। দূরপাল্লা বা কাছের যাত্রায়ও বাসের পরিবর্তে অনেকেই এখন প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস ভাড়া করছে। কিন্তু এসব ছোট গাড়ির অদক্ষ চালক ও তাড়াহুড়ার কারণে বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া গতিসীমা না মানা, গাড়ির ফিটনেস না থাকা, ইউ টার্ন নেওয়ার নিয়ম-কানুন না জানা ও মহাসড়কে ইচ্ছামতো সিএনজি অটোরিকশা চলাচলে ছোট গাড়িগুলোর দুর্ঘটনা বাড়ছে। এসব দুর্ঘটনায় শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেকের পুরো পরিবার।
গতকাল শনিবার সকালে প্রাইভেট কারে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর থেকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবিরাজবাড়ীতে যাচ্ছিলেন হাসিনা বেগমের চার সদস্যের পরিবার ও তাঁদের এক প্রতিবেশী। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভালুকা ডিগ্রি কলেজের সামনে প্রাইভেট কারটি ইউ টার্ন নেওয়ার সময় ইমাম পরিবহনের সঙ্গে সংঘর্ষে চালকসহ প্রাইভেট কারটির ছয়জনই ঘটনাস্থলে নিহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শী মলয় নন্দী জানান, বাসটির গতি ছিল বেপরোয়া। একই সঙ্গে ইউ টার্ন নেওয়ার সময় প্রাইভেট কারের চালকও ছিলেন অসচেতন। ফলে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। প্রাইভেট কারটি ময়মনসিংহের দিকে যাওয়ার সময় সম্ভবত সিএনজি নেওয়া বা নাশতা করার জন্য ইউ টার্ন নিতে চায়। সে সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, বিশ্বের অনেক দেশের সড়কে ইউটার্নই নেই। তারা ইউ লুপসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। আর যেসব দেশে ইউ টার্ন আছে সেখানেও একটি গাড়িকে ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার যেতে হয়। এরপর যথাযথ সিগন্যাল ব্যবস্থার মাধ্যমে ইউ টার্ন নিতে হয়। অথচ আমাদের মহাসড়কে যত্রতত্র ইউ টার্ন। এই ইউ টার্ন নেওয়ার জন্য গাড়িগুলোও যথাযথ নিয়ম মানছে না বা অন্য লেনের গাড়িগুলোও গতি কমাচ্ছে না।
গত শুক্রবার ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের রাবনা বাইপাস এলাকায় বাস-সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষে একই পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা ছিলেন মা-বাবা, ছেলে ও ছেলের স্ত্রী। গত বুধবার ময়মনসিংহ-শেরপুর মহাসড়কে ঘটে বড় মর্মান্তিক ঘটনা। এক আত্মীয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে যাচ্ছিল একই পরিবারের ১৪ জন। পথে মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ায় মা-মেয়েসহ আটজন নিহত হয়।
গত ১৫ আগস্ট সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের ওসমানীনগরে যাত্রীবাহী বাস ও সিএনজি অটোরিকশার সংঘর্ষে একই পরিবারের চারজনসহ পাঁচজন নিহত হয়েছে। ১৩ আগস্ট কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কে বাস ও প্রাইভেট কারের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজন নিহত হয়েছে। গত ৩১ জুলাই ঢাকা থেকে প্রাইভেট কারে সপরিবারে বাড়িতে ফেরার সময় সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের ওসমানীনগরে বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে মা-বাবা ও তিন সন্তান ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। ৩০ জুলাই ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের কাশিয়ানিতে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রেলওয়ে ফ্লাইওভারের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লাগায় ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের তিনজন নিহত হয়। ৮ জুলাই কুমিল্লার দাউদকান্দি-মতলব সড়কে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়লে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়।
করোনাকালে গাড়ি কম চলাচল করলেও যাত্রী কল্যাণ সমিতির গবেষণা মতে, এবারের ঈদুল আজহায় দুর্ঘটনা কমেনি। গত ২৬ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত ১৩ দিনে ২০১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪২ জন নিহত ও ৩৩১ জন আহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার ২৪.৩৭ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৫২.২৩ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা, ১৫.৯২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা ও ৭.৪৬ শতাংশ অন্যান্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সমিতি।
মোট যানবাহনের ৩২.৫৮ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৯.৩৫ শতাংশ বাস, ১৯.৩৫ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ড ভ্যান-লরি, ১০ শতাংশ ব্যাটারি রিকশা-ইজি বাইক-ভ্যান-সাইকেল, ৮.০৬ শতাংশ অটোরিকশা, ৭.৭৪ শতাংশ কার-মাইক্রো-জিপ ও ২.৯০ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মহেন্দ্র এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।
সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘করোনাকালে পরিবারের সদস্যরা নিরাপদে কোথাও যেতে বাসের চেয়ে প্রাইভেট কার-মাইক্রোবাসই বেশি ব্যবহার করছে। তবে দীর্ঘদিন গাড়ি বন্ধ থাকায় অনেক চালকই পেশা পরিবর্তন করেছেন। ফলে অদক্ষ বা নতুন চালক ও হেলপার দিয়েও অনেকে গাড়ি চালাচ্ছেন। আবার ছোট গাড়ির চালকদের ওপর চাপ পড়ছে। এতেও দুর্ঘটনা বাড়ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনাকালে ছোট গাড়ির চাহিদা বাড়ায় মালিকরা চালকদের সময় বেঁধে দিচ্ছেন। এতে সব সময়ই চালক তাড়াহুড়ার মধ্যে থাকছেন। অনেক অদক্ষ চালকই গতিসীমা মানছেন না। মহাসড়কে গাড়ি চালানোর যেসব নিয়ম-কানুন সেসবের তোয়াক্কা করছেন না। অনেক গাড়ির আবার ফিটনেস না থাকায় সেগুলো নানা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। আবার মহাসড়কে সিএনজি অটোরিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। এসব পরিবহন বাস, ট্রাকসহ অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই ইচ্ছামতো চলছে। ফলে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটছে।
বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘আমাদের রাস্তাঘাটে কিছু সমস্যা আছে। আবার চালকরাও রাস্তা পর্যবেক্ষণ না করে গাড়ি চালান। এ ছাড়া চালকদের অদক্ষতা, অসচেতনতা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তবে অন্যান্য দেশ এখন এমনভাবে রাস্তা ডিজাইন করছে, সেখানে ভুল করলেও দুর্ঘটনার আশঙ্কা খুবই কম। আমাদের ডিজাইনের দিকে নজর দিতে হবে। চালকদের প্রশিক্ষণ ও গাড়ির সেফটির বিষয়টিতে আরো নজর দিতে হবে।’