করোনার ছোবল, সাগরের বৈরিতা, ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার অলস সময় কাটিয়ে জেলেরা এখন সাগরমুখী। কয়েক দিন আগেও জেলেদের মধ্যে ছিল হতাশা, নীরব কান্না। সেসব অতিক্রম করে এখন সাগরে পৌঁছে জাল ফেললেই মিলছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। রুপালি ইলিশ ধরার নেশায় মগ্ন এখন জেলেরা। তাঁদের চোখে-মুখে ঝিলিক কাটছে হাসি, তৃপ্তি। ট্রলার ভর্তি ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরে ভালো দামেই বিক্রি করছেন। দীর্ঘদিন পর লাভের মুখ দেখে তৃপ্ত তাঁরা। আবার সন্তোষজনক দামে ইলিশ কিনতে পেরে ক্রেতাসাধারণও খুশি। কালের কণ্ঠ’র প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন—
বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বরিশালের একমাত্র ইলিশের মোকাম পোর্ট রোডে পা রাখা দায়। এই দুই মাস এখানে প্রচুর পরিমাণ লোকাল ইলিশ পাওয়া যায়। এবারও ইলিশে বাজার ভর্তি। তবে পোর্ট রোড কিছুটা নিস্তেজ। কারণ এবার লোকাল ইলিশ কম। বাজার দখল করে নিয়েছে সমুদ্রের ইলিশ।
বরিশালের ইলিশ মোকাম পোর্ট রোড বাজার, মাঠ-ঘাট, অলিগলিতে বর্তমানে মিলছে বিভিন্ন আকারের ইলিশ। দামে সস্তা হওয়ায় নগরবাসীও ইচ্ছামতো কিনছে। অবশ্য সাগরের ইলিশে স্বাদ কম হওয়ায় কেউ কেউ সন্তুষ্ট নয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি বছর ইলিশের সরবরাহ গত বছরের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। তবে নদীর ইলিশ কম। সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের কীর্তনখোলাপারের জেলে জসীম উদ্দীন জানান, সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ভোলার তেঁতুলিয়া কীর্তন খোলা নদীতে ইলিশ বেশি ধরা পড়ে। তবে এবার এই সময়ে নদীতে পর্যাপ্ত ইলিশ ধরা পড়েনি। গত শনিবার প্রায় চার হাজার মণ ইলিশ এসেছে মোকামে। এর মধ্যে বেশির ভাগ সমুদ্রের ইলিশ। স্থানীয় চাহিদা মোটানোর পর উদ্বৃত্ত ইলিশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই বরিশালে। এ কারণে দরপতন হয়েছে।
আড়তদার জহির সিকদার জানান, শনিবার মোকামে প্রায় চার হাজার মণ ইলিশ এসেছে। স্থানীয় বাজারে বিক্রির পর অবশিষ্ট ইলিশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। একসঙ্গে প্রচুর ইলিশ আসায় দরপতন হয়েছে।
আরেক আড়তদার ইয়ার উদ্দিন জানান, দেড় কেজি ওজনের প্রতি মণ ইলিশ ৩৬ হাজার টাকা, এক কেজি ২০০ গ্রামের প্রতি মণ ৩০ হাজার টাকা, এক কেজি ওজনের প্রতি মণ ২৭ হাজার টাকা। রপ্তানিযোগ্য এলসি সাইজ (৬০০ থেকে ৯০০ গ্রাম) ২০ হাজার টাকা। ভেলকা (৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম) প্রতি মণ ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে এত কম দামে ইলিশ বিক্রি হয়নি।
তবে খুচরা ক্রেতারা সুবিধা পাচ্ছে কম। খুব বেশি কম দামে ইলিশ কিনতে পাচ্ছে না তারা।
এদিকে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মৎস্যবন্দর আলীপুর-মহিপুরের সব মাছের আড়ত বর্তমানে বেশ সরগরম। স্থানীয় ছোট ট্রলারে আশানুরূপ ইলিশ ধরা না পড়লেও গভীর সমুদ্রে বড় ট্রলারে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ।
বিপুল পরিমাণ ইলিশ সরবরাহের কারণে দাম কম হওয়ায় ক্রেতারাও স্বস্তিতে। সরেজমিনে মহিপুর ও আলীপুর মৎস্যবন্দরে গিয়ে দেখা গেছে, শিববাড়িয়া নদীর দুই তীরে অসংখ্য ট্রলার ইলিশ নিয়ে আড়তের ঘাটে নোঙর করা। শ্রমিকরা ট্রলার থেকে ইলিশ নামিয়ে আড়তে স্তূপ করছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, ‘দেড় কেজি ওজনের ইলিশ কেজি ৭৫০ থেকে ৭৭৫ টাকা। আর প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকায়। ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ কেজি ৫৫০ টাকা। প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ২২ হাজার টাকায়। ছোট আকারের ইলিশ কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪২৫ থেকে ৪৫০ টাকা। মণ ১৭ হাজার টাকা।’
সীতাকুণ্ডের (চট্টগ্রাম) সলিমপুর থেকে বারৈয়াঢালা পর্যন্ত এলাকায় ১৩৮টি জেলেপাড়া আছে। এসব জেলে পল্লীতে প্রায় পাঁচ হাজার মৎস্যজীবীর বাস। এসব জেলেরা বছরজুড়ে সাগরে মাছ ধরলেও অপেক্ষায় থাকে ইলিশ মৌসুমের জন্য।
জেলেরা জানান, এবার সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে তাঁদের জালে। বর্তমানে স্থানীয় বাজারে এক কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এ মূল্যে সন্তুষ্ট নন জেলেরা।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শামীম আহমদ বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের ১৩৮টি জেলেপাড়ায় চার হাজার ৮০০ নিবন্ধিত জেলে আছেন। তাঁরা সাগর থেকে ইলিশ সংগ্রহ করে সারা দেশে রপ্তানি করেন। এবার আমরা আট হাজার মেট্রিক টন ইলিশ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। ইতিমধ্যে ছয় হাজার মেট্রিক টনের মতো মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকিটাও সংগ্রহ করা হবে।’