রোগতত্ত্বের সূত্র অনুসারে করোনাভাইরাসের মহামারি থেকে কোনো দেশকে মুক্ত করতে মোট জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশের মধ্যে অ্যান্টিবডি নিশ্চিত করতে হবে। এদের প্রভাবে বাকি ২০ শতাংশ মানুষের দেহে আপনা থেকেই ইউমিউনিটি তৈরি হয়ে যাবে। আর এর মধ্য দিয়ে পুরো জনগোষ্ঠীর সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা মিলবে। এমন তত্ত্ব সামনে রেখে দেশে সাড়ে ১৭ কোটি মোট জনসংখ্যা ধরে ১৪ কোটি মানুষের দেহে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের টিকার জোগান নিশ্চিত হয়েছে। বাকি ৯ কোটি মানুষের টিকার জোগান এখনো অনিশ্চিত।
জানা গেছে, দুটি উৎস থেকে চার কোটি ৯০ লাখ মানুষের জন্য টিকার জোগান নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষের টিকা আসবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্লোবাল ফান্ডের সমন্বিত কোভেক্স গ্রুপ থেকে। আর দেড় কোটি মানুষের টিকা আসবে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মা ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা থেকে।
ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আরো প্রয়োজন হবে ৯ কোটি মানুষের টিকা। তা কোথা থেকে মিলবে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সরকারের সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও যার যার যোগসূত্র ধরে আরো টিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
অন্যদিকে মাত্র এক দিন আগেই ৯০ শতাংশ কার্যকারিতা দেখানোর খবর দেওয়া ফাইজারের টিকা বাংলাদেশে ব্যবহারে বড় বাধা হয়ে আছে মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। ফলে ওই টিকা যতই কার্যকর হোক তা বাংলাদেশে আনার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ সরকারি বা বেসরকারি তরফ থেকে নেওয়া হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজির অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, মহামারি থেকে মুক্ত হতে যখন দেশে টিকার প্রয়োগ শুরু হবে তখন যতটা কম সময়ের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের সবাইকে টিকার আওতায় আনা যাবে তত বেশি সাফল্য মিলবে। তা না হলে এক বছরে পাঁচ কোটি, আবার পরের পাঁচ বছর বসে থেকে বাকি ৯ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হলে সংক্রমণও ঝুলে থাকার ঝুঁকি থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, কোভেক্স থেকে প্রথম ধাপে ২০ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা পাওয়া যাবে। তারা পরবর্তী সময়ে আরো ৪০-৫০ শতাংশ মানুষের টিকা দেওয়ার আভাস দিয়েছে। তবে পরবর্তী ধাপের ওই টিকার দাম বেশি পড়বে। আবার হাতে পেতে সময়ও বেশি লাগতে পারে। এর আগেই বেসরকারি পর্যায়ে দেশের বাজারে কোনো না কোনো কম্পানির টিকা চলে আসতে পারে। ওই কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুসারে, কোভেক্স গ্রুপ থেকে আরো প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষের টিকা পেলে এবং এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া পাঁচ কোটি টিকা মিলে ১৩ বা সাড়ে ১৩ কোটি মানুষের টিকার জোগান হবে।
আরো যে ১০টি টিকার তৃতীয় ধাপের চূড়ান্ত ট্রায়াল চলছে কিংবা যে ছয়টি টিকা বিভিন্ন দেশে স্বল্প পরিসরে ব্যবহারের অনুমোদন মিলেছে তার কোনোটিই এখনো বাংলাদেশে আসার মতো কোনো উদ্যোগ বা খবর মিলছে না। তবে ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ভারত বায়োটেক’ ও ফ্রান্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সানোফি পাস্তুরের টিকার তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের অংশবিশেষ বাংলাদেশে পরিচালনার প্রক্রিয়া চলছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের টিকার ট্রায়াল চালাচ্ছে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ-আইসিডিডিআরবি। তারা ভারত বায়োটেকের ট্রায়ালেরও প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে সানোফির ট্রায়াল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে করার প্রাথমিক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আইসিডিডিআরবিতে সানোফির ট্রায়ালের আরেকটি অংশ করার কাজ চলছে। বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সানোফির সঙ্গে চলতি সপ্তাহ বা আগামী সপ্তাহের শুরুর দিকেই আনুষ্ঠানিক চুক্তি হবে। আমাদের দেওয়া শর্তগুলো ওই কম্পানি পর্যালোচনা করছে। ওই কম্পানি থেকে কিছু টিকা বিনা মূল্যে ও কিছু স্বল্প মূল্যে যাতে পাই এমন কিছু প্রসঙ্গ আমরা তুলে ধরেছি।’
আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. কে এম জামান বলেন, ভারত বায়োটেক ও সানোফির সঙ্গে আমাদের ট্রায়ালকেন্দ্রিক চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে। তবে ওই দুই কম্পানি থেকে আমরা কী পরিমাণ টিকা পাব সে পর্যায়ে এখনো আলোচনায় অগ্রগতি হয়নি। এ ছাড়া চীনের সিনোভেক কম্পানির ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের আর কোনো অগ্রগতি নেই। চুক্তি অনুযায়ী ট্রায়াল সফল হলে কম্পানিটি বাংলাদেশকে বিনা মূল্যে এক লাখ ১০ হাজার ডোজ টিকা দেওয়ার কথা ছিল।
গ্লোব বায়োটেকের ড. আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের সব কিছুই আইসিডিডিআরবির ওপর ছেড়ে দিয়েছি। এখন যা করার তারা করবে। কিন্তু কাজটি বোধ হয় একটু বেশি ধীরগতিতে এগোচ্ছে।