করোনা দুর্যোগের এই সময়ে কর্মহীনতা বা আয় কমে যাওয়ায় অভিভাবকদের অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি পরিশোধ করতে পারছেন না। তাঁরা দাবি তুলেছেন টিউশন ফি ৫০ শতাংশ কমানোর। আবার সব শিক্ষার্থীর অভিভাবক বেতন দিচ্ছেন না উল্লেখ করে টিউশন ফি কমানোর ব্যাপারে ভাবছে না স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি আদায় নিয়ে জটিলতা বাড়ছে। এ নিয়ে আন্দোলন-কর্মসূচি দিতে যাচ্ছেন অভিভাবকরা।
টিউশন ফি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেকটাই নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে আছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের মানবিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মন্ত্রী বলেছেন, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আগামী কয়েক মাস চলার সামর্থ্য আছে তাদের উচিত সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়া। আর সামর্থ্যবান অভিভাবকদের উচিত হবে টিউশন ফি পরিশোধ করা।
অভিভাবকরা বলছেন, করোনা মহামারির মধ্যে সব কিছু বন্ধ থাকায় আয় কমেছে সবারই। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইন ক্লাস চলায় প্রতিষ্ঠানের খরচও অনেক কমেছে। এ অবস্থায় শতভাগ বেতন আদায় করা কোনো যুক্তির মধ্যে পড়ে না। আর যেসব স্কুলের ফান্ড রয়েছে, তাদের তো কয়েক মাস বেতন না নিলেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে ৫০ শতাংশের বেশি বেতন নেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছে, টিউশন ফি আদায় করেই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। বর্তমান অবস্থায় টিউশন ফি পাওয়া যাচ্ছে না বলে শিক্ষকদের বেতন দিতেই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
সচ্ছল অভিভাবকরা ফি পরিশোধ করলে সত্যিকার অর্থে সমস্যায় পড়া অভিভাবকদের ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে ভাবা যেত।
জানা যায়, রাজধানীসহ দেশের বড় বড় স্কুল অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। একই সঙ্গে তারা টিউশন ফি আদায় অব্যাহত রেখেছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়মিতই টিউশন ফি আদায়ে এসএমএস ও নোটিশ দিচ্ছে। এমনকি শিক্ষকরা অভিভাবকদের ফোনও দিচ্ছেন।
রাজধানীর অনেক স্কুলই আবার অমানবিক আচরণ করছে। করোনাকালেও দুই-তিন মাসের বেতন অগ্রিম নেওয়া অব্যাহত রেখেছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ সম্প্রতি এমন নোটিশ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা অনলাইনে পুরোপুরি ক্লাস চালাচ্ছি। তবে জুন পর্যন্ত অর্ধেক শিক্ষার্থী বেতন দিয়েছে। তা দিয়ে কোনোমতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন অব্যাহত রাখা হয়েছে। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের ফি পেলে আগামী মাসগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারব।’
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা পড়ালেখা করে। করোনাকালে তারাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছে। অনেক বেসরকারি চাকরিজীবী বেতন পাচ্ছেন না। আবার যাঁরা ছোটখাটো ব্যবসা করতেন তাঁদের আয়ও বন্ধ। এ অবস্থায় স্কুলগুলোর অগ্রিম বেতনের নোটিশ অমানবিক। আমরা ছয় মাসের বেতন সম্পূর্ণ মওকুফের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। সাড়া মেলেনি। এখন আমরা প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দেব।’
জানা যায়, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোতে সাধারণত ৮০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে বেতন হওয়ায় মোটামুটি সচ্ছলরা তা পরিশোধ করতে পারছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সন্তানের টিউশন ফি নিয়মিতই দিচ্ছেন। তবে বেসরকারি চাকুরে ও ছোট ব্যবসায়ী, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তা পারছে না। আবার বকেয়া পড়ে যাওয়া কয়েক মাসের ফি একসঙ্গে দেওয়াটা তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে ইংলিশ মিডিয়ামের মধ্যবিত্ত অভিভাবকরা বড় সংকটে আছেন। কারণ তাদের মাসে পাঁচ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ফি দিতে হয়। ফলে তাঁরা নিয়মিতই বিভিন্ন স্কুলের সামনে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন।
প্যারেন্টস ফোরাম অব মাস্টারমাইন্ড স্কুলের সভাপতি এ কে এম আশরাফ বলেন, ‘করোনাকালে আমরা ৫০ শতাংশ টিউশন ফি নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। এই দাবি কোনো নির্দিষ্ট স্কুলভিত্তিক নয়, সামগ্রিক। আমরা অভিভাবকদের আহ্বান জানাব, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জুলাই থেকে ফি না দিতে। কোনো সিদ্ধান্ত না এলে আগামী ১৫ জুলাই পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব।’