মঙ্গলবার, ০১ জুলাই, ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

দ্রব্যমূল্য যেন লাগামহীন ঘোড়া

প্রকাশিত: ০৯:৩৪ পিএম, নভেম্বর ৬, ২০২১

দ্রব্যমূল্য যেন লাগামহীন ঘোড়া

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মানুষের জীবনের অনুষঙ্গ। প্রতিদিন কিনতে হয়। খেতে হয়। একদিন না কিনলে না খেলে জীবন চলে না। মানব জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়ানো এই জিনিসের দাম বাড়া মানে জীবন থমকে দাঁড়ানো। জীবনের গতিতে বাধা। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এমন বাধা প্রায়ই আসে। কথায় কথায় দ্রব্যের দাম বাড়ে। দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে মানুষের নাভিশ্বাস। জীবন অতিষ্ঠ। প্রতিদিন যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে মানুষ বাঁচবে কীভাবে? খাবে কী? ৯০ টাকার খোলা সয়াবিন তেল ১৮০ টাকা লিটার। পুরোপুরি দ্বিগুণ। মানুষের আয় কী দ্বিগুণ বেড়েছে? নিশ্চয়ই না। করোনা মহামারির কারণে আয় বরং কমেছে। কেউ চাকরি হারিয়েছে। কারও নিয়মিত বেতন হচ্ছে না। ইত্যকার সব সমস্যা। বাড়তি দ্রব্যমূল্যের ভূতটা মানুষকে জেঁকে ধরেছে। জীবন বাঁচাতে মানুষ অস্থির। টিসিবির ট্রাকের সামনে বিশাল লম্বা লাইন। কয়টা টাকা বাঁচানোর জন্য সাধারণ মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানো। আয়-রোজগার কম থাকলে এমনই হয়। একই তো দীর্ঘদিন আয়-রোজগার নেই তারপর আবার ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। কীভাবে চলবে সাধারণ মানুষ? কীভাবে চালাবে জীবন? টাকা-পয়সার অভাবে জীবনের অনেক কিছুই কাটছাঁট করতে হচ্ছে। শখ আহ্লাদ বাদ দিতে হচ্ছে। জিনিসের দাম বাড়ায় অনেকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরাচ্ছে। এক টাকার জিনিস দশ টাকায় কিনতে গিয়ে কোনোরকম চালাচ্ছে সংসার। কেন জিনিসপত্রের দাম এমন লাগামহীন বাড়ছে তার কোনো জবাবদিহিতা নেই। কে কাকে কেন জবাব দেবে এমন একটা অবস্থা। সাধারণ মানুষের যত জ্বালা। কদিন আগে যে পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০ টাকা কেজি বর্তমানে তা ৬০ টাকা কেজি। চিনির কেজি ছিল ৬০ টাকা। বর্তমানে ৮০ টাকা। পাড়া-মহল্লার কোনো কোনো দোকানে ৯০ টাকা। মসুর ডাল সাধারণ দোকানে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। খোলা আটা প্রতিকেজি ৩৫ টাকা। মাত্র কদিন আগে ছিল ২৫ টাকা। কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেশি। যে পরিবারে মাসে ২০ কেজি আটা লাগে সে পরিবার প্রতি মাসে শুধু আটার জন্য বাড়তি দিচ্ছে ২০০ টাকা। ১০টা সামগ্রীর জন্য ২ হাজার টাকা। এই বাড়তি টাকাটা পাবে কোথায়? কে দেবে অতিরিক্ত টাকা? বাধ্য হয়ে বেশি টাকা দিয়ে কম জিনিস কিনে ঘরে ফিরতে হয়। এক পেটের জায়গায় আধপেট খেতে হয়। সরকার নিয়ন্ত্রিত টিসিবির ট্রাকে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা। মসুর ডাল ৫৫ টাকা। সয়াবিন তেল ১০০ টাকা। খোলা আটা প্রতিকেজি ২২ টাকা। পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৩০ টাকা। সরকারি দামের সঙ্গে বেসরকারি দামের এত পার্থক্যের কারণইবা কী? যেমন ধরা যাক চিনির কথা। দীর্ঘদিন ধরে চিনির দাম কমছেই না। শত শত টন বিদেশি চিনি আসছে বাংলাদেশে তারপরও দাম কমছে না। বলা যায়, চিনি নিয়ে চলছে নানা তেলেসমাতি। বাজারে বাজারে ঘুরে বাংলাদেশের চিনিকলে উৎপাদিত চিনির কোনো হদিস পাওয়া যায় না। আমাদের চিনিকলে উৎপাদিত চিনি পুরোপুরি বাজারে ছাড়লে চিনির দাম এত আকাশছোঁয়া হওয়ার কথা না। বাংলাদেশের চিনি গুণেমানে অনন্য। অনেক দেশের চিনির চেয়ে অনেক ভালো। দোকানে চা খেতে গেলে দেখা যায় প্লাস্টিকের মতো চিনি। পাঁচ মিনিট নাড়াচাড়ার পরও গলে না। আমাদের দেশের চিনি পানিতে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিশে যায়। মিষ্টিও বেশি। কোনো এক অজানা কারণে বাংলাদেশের চিনি পুরোপুরি বাজারে আসে না। নানারকম সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে আমরা দেশি চিনি না পেয়ে বিদেশের নিম্নমানের চিনি খাচ্ছি। বিষয়টা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। শুধু চিনি নয়, এমন আরও অনেক পণ্য আছে যার দাম বাড়ার কোনো কারণ নাই। তারপরও হুড়হুড় করে বাড়ছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দ্রব্যের দাম বাড়ানোর মতো ঘৃণ্য কাজটা করছে। আন্ডারগ্রাউন্ডে বসে থাকা এই শ্রেণিটাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে একেকটা দ্রব্যকে টার্গেট করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ ওই শ্রেণিটার হাতে পুরোপুরি জিম্মি। কোনো এক অজানা কারণে সরকারও অনেক সময় তাদের সঙ্গে পেরে ওঠে না। রহস্যটা অনেকের জানা। স্বাভাবিক জ্ঞান থেকে বোঝা যায়, মুনাফার একটা ব্যাপার কাজ করছে। অনেকেই লাভবান হচ্ছে বলে তাদের সহায়তায় অসাধু ব্যবসায়ী মহলটি নীরবে চালিয়ে যাচ্ছে কারসাজি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তারা মুনাফা লুটছে। সাধারণ মানুষের চোখের সামনে ঘটছে; কিন্তু কিছুই বলতে বা করতে পারছে না। তারা যে বড় অসহায়। মাত্র কদিন আগে কারওয়ান বাজারে যে ঢেঁড়স ছিল ১০ টাকা কেজি গতকাল তা কিনেছি ৬০ টাকা কেজি। ছয়গুণ বেশি দাম। অন্যান্য সবজিরও একই অবস্থা। পাঁচগুণ ছয়গুণ বেশি। ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি। প্রশ্ন হলো, সাধারণ মানুষ কী অপরাধ করেছে যে তাদেরকে এত বড় শাস্তি পেতে হবে? তারা সবার কাছেই জিম্মি। ব্যবসায়ীদের কাছে, সরকারি আমলাদের কাছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে। কতকাল এভাবে চলবে সাধারণ মানুষ? দ্রব্যমূল্য বাড়লে নিম্ন আয়ের মানুষের মাথায় আগুন ধরে যায়। দিশেহারা হয়ে যায় অনেকে। হওয়ার কারণ অনেক। প্রথমত, জিনিসের দাম বাড়ে বিদ্যুৎ গতিতে, মানুষের আয় বাড়ে কচ্ছপগতিতে। এক টাকার জিনিসের দাম যদি রাতারাতি ১০ টাকা হয় তা হলে কে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারবে? এক টাকার জিনিস ১০ টাকায় কেনার সামর্থ্যইবা কজনের আছে? সবার আয়-রোজগারের একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। সীমার বাইরে গিয়ে আয় করবে কীভাবে? তারপরও সাধারণ মানুষ ধীরস্থির আছে। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। পেছনে যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। সিন্ডিকেটের নামে যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তাদের লাগাম টেনে ধরার সময় এক্ষুনই। দেশের লাখো-কোটি মানুষ বাঁচাতে কখনও কঠোর হতে হয়। সরকারকে এ বিষয়টায় অবশ্যই কঠোর হতে হবে। শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে জিনিসপত্রের দাম। মাত্র কদিন পরই শীতকালীন সবজি বাজারে আসবে। ট্রানজেকশনের এই সময়টায় সবজির দাম কিছুটা বাড়ে। ১০ টাকার সবজি বড়জোর ১২ টাকা হয়। ৬০ টাকা নয়। কাদের কারসাজিতে এমনটা হচ্ছে তা অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। যদিও সরকারের প্রায় সব সংস্থার কাছেই এদের সব তথ্য আছে। অনেক সময় বলা হয়, কারা এই সিন্ডিকেট করেছে? প্রশ্নটা অবান্তর তারপরও সাধারণ মানুষ মেনে নেয়। তাদের প্রশ্ন হলো- ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট নিশ্চয়ই সরকারের চেয়ে শক্তিশালী নয়? সরকার চাইলে যেকোনো সিন্ডিকেট গুঁড়িয়ে দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। এর জন্য দরকার প্রশাসনিক সহযোগিতা। দেশের মানুষ বাঁচাতে, তাদের জীবনে স্থিরতা ফেরাতে প্রশাসন অবশ্যই সরকারকে যথাযথ সহযোগিতা করবে। একটা সমাজে নানা শ্রেণি, পেশা, মতাদর্শের মানুষ থাকে। সব মানুষের চালচলন, আচার-আচরণ, রুচি-নীতি এক নয়। কেউ অনিয়ম, অন্যায়, অবিচার করে। কেউ তা প্রশ্রয় দেয়। কেউবা নীরবে সহ্য করে। যার কারণে সমাজে অনিয়ম হয়। অন্যায় অবিচার হয়। হুট করে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়াটা অন্যায়, অবিচার। এই মুহূর্তে এর একটা বিহিত হওয়া জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো কে বিহিত ব্যবস্থা করবে? বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? নিশ্চয়ই সরকার ও সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই। সঙ্গে থাকবে ব্যবসায়ী সমাজ। এই সমাজটার ভূমিকাই হবে মুখ্য। কারণ তারাই দ্রব্যমূল্যের মূল নিয়ন্ত্রক। বলা যায় চালিকাশক্তি। দূরে দাঁড়িয়ে কলকাঠি তারাই নাড়ে। সাধারণ মানুষ শুধু নীরব দর্শক। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী সরবরাহ কম এবং চাহিদা বেশি হলে দ্রব্যের দাম বাড়ে। কিন্তু সে বাড়ারও একটা সীমা পরিসীমা থাকে। সীমাহীন কোনোকিছু অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে না। বাংলাদেশের দ্রব্যের বাজারের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে অর্থনীতির সব তত্ত্ব, নিয়ম-কানুন পাল্টে গেছে। উল্টে গেছে সব। এক দ্রব্যমূল্য নিয়ে চিন্তা করতে করতে মানুষের নাওয়া-খাওয়া, ঘুম হারাম। জীবন বাঁচাবে নাকি জীবিকা? আয়-রোজগারের চিন্তা করবে নাকি চড়া দামে জিনিস কিনে জীবন চালাবে? একটা ভয়াবহ অবস্থা। চারদিকে কেমন যেন অস্থিরতা। মানুষের মনে শান্তি নেই। করোনার কারণে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে যে ধাক্কাটা লেগেছে তা সামলাতে সরকার যেমন হিমশিম খাচ্ছে, তেমনি হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। তারা স্বাভাবিক নিয়মে জীবন চালাতে পারছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নতুন পেরেশানি যুক্ত করেছে। করোনা মহামারির ধাক্কা সামলাতে আরও সময় লাগবে। সময় লাগবে মানুষের আয়-রোজগারে স্বাভাবিক গতি আসতে। তার মধ্যে আবার দ্রব্যের দামের বাড়তি ধাক্কা। এত ধাক্কাধাক্কি মানুষ সহ্য করতে পারছে না। তারপরও মানুষের ঘাড়ে চেপে বসছে একের পর এক ঝামেলা। জীবনকে করে তুলছে দুর্বিষহ। সরকারকে তাই এর একটা বিহিত করতেই হবে। শীত চলে এসেছে। আবার যদি অন্য কোনো শীতকালীন রোগবালাই আসে তাহলে তাও সামাল দিতে হবে সাধারণ মানুষকে। প্রকৃতিতে মানুষের কোনো হাত নেই। মানুষের তৈরি সমস্যায় অবশ্যই হাত আছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের তৈরি সমস্যা। গুটিকয়েক মানুষ মিলে যে সিন্ডিকেট করেছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এই সিন্ডিকেটের তৈরি সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান সরকারের হাতের নাগালে। একদিকে খাদ্যমন্ত্রী বলছেন, বাংলাদেশে খাদ্যের কোনো সঙ্কট নেই, অন্যদিকে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তা হলে কোনটা সঠিক? সরকারকে অবশ্যই সঠিক তথ্যটা সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে। চলমান পাগলাঘোড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অবশ্যই থামাতে হবে।
Link copied!