বিশেষ সংবাদদাতা: বৈশ্বিক করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারী প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে নকল মাস্ক সরবরাহ করার অভিযোগে মামলায় পরেছেন আওয়ামী লীগের উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন ও সাবেক সহ-সম্পাদক শারমিন জাহান। আমিনের প্রতিষ্ঠানের নাম এলান কর্পোরেশন আর শারমিনের প্রতিষ্ঠানের নাম অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল। এই দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে নকল মাস্ক সরবরাহ করার অভিযোগে মামলা হয়েছে। একাধিক চিকিৎসক বলেছেন আমাদের জীবনকে ওরা ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
শারমিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নকল ‘এন৯৫’ মাস্ক সরবরাহের অভিযোগে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ রাজধানীর শাহবাগ থানায় শারমিনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শুক্রবার মামলাও করেছে। জানা গেছে ‘অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল’ নামে দেশি একটি প্রতিষ্ঠান চীনের ‘থ্রিএম কোম্পানি’র লোগো বসিয়ে এসব মাস্ক সরবরাহ করেছেন শারমিন।
একাধিক সুত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার শারমিন জাহান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে তিনি শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। সম্প্রতি একটি অনলাইন নিউজপোর্টালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের’ স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহান করোনাকালে বিএসএমএমইউতে মাস্ক সরবরাহের কথা উল্লেখ করেন। শারমিন জাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের প্রশাসন-১ শাখায় সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিএসএমএমইউতে নকল মাস্ক সরবরাহের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য শারমিন জাহানের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন ‘যারা মাস্ক সাপ্লাই দিচ্ছে, তারা সেগুলো প্রথমে আমাদের জমা দেয়। সরবরাহ করা মাস্ক ডিজি অফিস (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) কর্তৃক নির্ধারণ করা একটি প্রতিষ্ঠান থেকে টেস্ট করা হয়। তখন সেগুলোর মান ঠিক ছিল এবং এ ধরনের মাস্কই সরবরাহ করার কথা। পরে ৪ জুলাই থেকে মাস্ক সরবরাহ শুরু হয়। প্রতি লটে আমাদের সাড়ে সাতশ’র মতো মাস্ক লাগে। কারণ ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়, টেকনিশিয়ান, ক্লিনার সবাইকে মাস্ক দিতে হয়। এরা যখন একবারে ডিউটিতে যায়, তখন আমাদের এ পরিমাণ মাস্ক লাগে। তিনি আরও বলেন,বাজারে যত মাস্ক আছে, সব নিয়ে আমরা ছোট একটা গ্রুপ করলাম। সেখান থেকে আমাদের চিকিৎসকরা তিনটি কোম্পানির মাস্ক নির্বাচন করল। সেগুলো আবার টেস্ট করা হলো। টেস্টে ওদেরটাই (অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল) টিকেছে। ওরা যে স্যাম্পল দিয়েছিল সেটা টেস্ট করেই ঠিক করা হয়েছে। প্রথম লটে সরবরাহ করা মাস্ক নিয়ে কোনো অভিযোগ ওঠেনি জানিয়ে উপাচার্য বলেন, প্রথম লটে কোনো ধরনের কোনো সমস্যা হয়নি। দ্বিতীয় লটেও কোনো ধরনের কোনো সমস্যা ছিল না।
গত ১৮ জুলাই যখন তৃতীয় লটের মাস্ক ব্যবহার শুরু হলো, তখন দেখা যাচ্ছে, এক গ্রুপের মাস্কে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অন্য গ্রুপের মাস্কের মধ্যে কিছু মাস্ক নকল, ফেইক। আমাদের ডাক্তাররা তো ভালো বোঝে ও জানে। তারা দেখে যে সেগুলো নকল। তখন সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো তুলে নেওয়া হলো ও আসল মাস্ক দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে যারা সাপ্লাই দিয়েছে, তাদের বলা হলো যে, এসব মাস্ক আমরা নেব না। আমাদের ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা তো হুমকির মুখে। তোমরা এগুলো কী করলে? তারাও (সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান) সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ফেরত নিয়ে গেছে। এখন কেন এটা করল সে জন্য আমরা তাদের কাছে লিখিত ব্যাখ্যা চেয়েছি এবং তার সঙ্গে সঙ্গে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, এটা খতিয়ে দেখার জন্য। অধ্যাপক ডা.কনক কান্তি বড়ুয়া আরও বলেন, ‘হাসপাতালের ক্রয় প্রক্রিয়া অনুযায়ীই (মাস্ক) কেনা হয়েছে। আমরা মনে করি, তারা (অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল) প্রতারণা করেছে। আমাদের জীবনকে ওরা ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। আমরা তদন্ত করছি। এদিকে শারমিনের অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালকে চাওয়া লিখিত বাখ্যা গ্রহনযোগ্য না হওয়ায় শুক্রবার তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেছে বিএসএমএমইউ। বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) অনুসন্ধান করছে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সার্জিক্যাল মাস্ক আমদানি করতে গিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিনের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এনে মামলাও করেছে খোদ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরই। আমিনুল ইসলামের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার বারদোনায়।
নিম্নমানের ৫০ হাজার কেএন-৯৫ মাস্ক আমদানি করতে গিয়ে প্রতারণা ও ভুয়া কাগজ ব্যবহারের অভিযোগে মহাখালী ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ফখরুল ইসলাম বাদি হয়ে এলান কর্পোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্ত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম আমিনের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। গত ২৯ মে রাজধানীর বনানী থানায় ৪৬৮, ৪৭১ ও ১৯৮ ধারার মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘(এলান কর্পোরেশনের আমিনুল ইসলাম) জাল ও বানোয়াট কাগজপত্রাদি দাখিলের মাধ্যমে করোনাভাইরাস জনিত (কোভিড-১৯) রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের ব্যবহারের জন্য কেএন-৯৫ মাস্ক আমদানি করে জনজীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর গত মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে সরবরাহ করা ‘এন৯৫’ মাস্ক এবং অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রীর মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মাস্ক নিয়ে লিখিত অভিযোগ করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, প্যাকেটের গায়ে এন৯৫ লেখা থাকলেও নিম্নমানের মাস্ক এবং পিপিই দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। কেবল মুগদা নয়, ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকটি হাসপাতাল থেকেও নিম্নমানের মাস্ক নিয়ে অভিযোগ আসে। ব্যবসার নামে প্রতারনা কিংবা নকল মাস্ক সাপ্লাইয়ের নামে প্রতারনার দায় দল ও সরকার নেবে না বলে সরকার দলীয় একাধিক নেতা জানিয়েছেন। নেতারা মনে করেন এসব কর্মকান্ডের দায় ব্যক্তির দলের নয়।