করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিপর্যয়ে পড়েছেন মাঝারি, অতিদরিদ্র মানুষেরা। এতে নতুন এক দরিদ্র শ্রেণির সৃষ্টি হচ্ছে। শহরাঞ্চলে ৮২ শতাংশ ও গ্রামে ৭৯ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া নতুন সৃষ্ট দরিদ্র শ্রেণির আয় ৭১ শতাংশ কমে গেছে। সর্বোচ্চ ১ থেকে ২ সপ্তাহ চলতে পারবেন তারা। ফলে প্রথাগত ত্রাণ সহায়তার বাইরে আর জরুরি ভিত্তিতে ওএমএস চালু করতে হবে। এ জন্য প্রায় ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) করা এক জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল এক ভিডিও কনফারেন্সে ‘পোভার্টি ইমপ্যাক্ট অব কোভিড-১৯’ শীর্ষক এ গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। গবেষণায় ৫ হাজার ৪৭১টি পরিবারের ওপর এ জরিপ চালানো হয়।
জরিপে পরিবারগুলো জানায়, সংকট শুরু হওয়ার পর ব্যক্তিগত সঞ্চয় বা ধারদেনা করে তারা চালাচ্ছেন। কিন্তু এখন অর্থ ও খাদ্যসহায়তা না পেলে আর মাত্র ১০ দিন টিকতে পারবেন তারা। তাই এ মাসের শেষে এসব পরিবারের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়বে।
ভিডিও কনফারেন্সে মূল গবেষণাপত্র তুলে ধরেন বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন। জরিপের উপাত্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, ৪ থেকে ১২ এপ্রিল এ জরিপ হয়। যেসব পরিবারের ওপর জরিপ হয়েছে, এগুলোর গড় আকার ৪ দশমিক ৮৫। তিনটি
দরিদ্র শ্রেণির ওপর জরিপ হয়েছে। তাদের মধ্যে নিম্ন দরিদ্র শ্রেণির মানুষই বেশি, ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ। ১৫ শতাংশ উচ্চ দরিদ্র শ্রেণি, আর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশের নতুন দরিদ্র। এসব মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাধারণ দিনমজুর, তাদের সংখ্যা ৪১ শতাংশ। এ ছাড়া আছেন কৃষক, নিয়মিত মজুরি পাওয়া শ্রমিক ও ছোট ব্যবসায়ী।
করোনায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে শহরে কাজ হারিয়েছেন ৭১ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ। গ্রামে এ সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম, ৫৫ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে খাবারের জন্য ব্যয় কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শিকার নতুন দরিদ্ররা। তাদের ৩৬ শতাংশ ব্যয় কমাতে হয়েছে।
এসব মানুষের পুষ্টি পরিস্থিতির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। সেখানে পুষ্টির পরিমাণ কমেছে ২৩ শতাংশ, গ্রামে ১৫ শতাংশ। শহরে মানুষের খাবারের পরিমাণ কমে গেছে ৪৭ শতাংশ, গ্রামে ৩২ শতাংশ। মাত্র ১৪ শতাংশ সরকারি সহায়তা পেয়েছে। আর ৫ শতাংশ পেয়েছে এনজিওর সহায়তা।
এভাবে নিম্নআয়ের মানুষের খাবারের জন্য লড়াই বেশি দিন চালাতে পারবে না। গ্রামের মানুষ বলছেন, তারা হয়তো ১৩ দিন চলতে পারবেন। কিন্তু শহরে আট দিনের বেশি মানুষ চলতে পারবেন না।
পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি এমন যে এ মাসের শেষের দিক থেকে বিপুলসংখ্যক নিম্নআয়ের মানুষ বড় ধরনের খাদ্যসংকটে পড়বে। এ অবস্থায় তাদের জন্য সহায়তা দরকার।
জরিপের ওপর ভিত্তি করে জিল্লুর বলেন, গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলো ৬ হাজার ৬০০ টাকা এবং শহরে থাকা দরিদ্র পরিবারগুলো ৮ হাজার ১০০ টাকার মধ্যে এক মাস চলতে পারে। আর এসব মানুষকে জরুরি ভিত্তিতে এক মাসের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা দরকার। এটি শুধু এক মাসের জন্য। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে আরও সহযোগিতা লাগবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর বলেন, সরকারের প্রথাগত যে ত্রাণসহায়তার ধরন, তা দিয়ে এবারের পরিস্থিতি সামলানো যাবে না। এ জন্য ভিন্ন ভাবনার দরকার। সবচেয়ে জরুরিÑ দ্রুত ওএমএস চালু করা। সামাজিক দূরত্ব পালনে সমস্যা থাকলে তা যাতে পালন করা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজে যাদের নিয়োজিত করার, তাদের করতে হবে।
এই জরিপের বিষয়ে কথা হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘সরকারের হাতে পর্যাপ্ত খাদ্য আছে। তাই এ মাস শেষে পরিস্থিতি খারাপ হবে বলে মনে করি না।’
তবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশের চরম দরিদ্র ১০ শতাংশ, মাঝারি দরিদ্র ১০ শতাংশ আর পরিস্থিতির কারণে আরও ৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র অবস্থায় পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে গবেষণায় যে অর্থের কথা বলা হয়েছে, তা হয়তো ঠিক আছে। তবে পরিস্থিতি খারাপ হবে না।