জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের মামলায় বিদেশে পলাতক প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারকে গ্রেপ্তারে আড়াই মাসেও পরোয়ানা জারি না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। অবশ্য দেশের সর্বোচ্চ আদালত গতকাল বুধবার এই ক্ষোভ প্রকাশের পর বিকেলে নিম্ন আদালত থেকে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় গতকাল পি কে হালদারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই নির্দেশ দেন। দুদকের কৌঁসুলি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর এই তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, গত ২৬ নভেম্বর মৌখিকভাবে পরোয়ানার আদেশ হয়। সেই আদেশ প্রস্তুত হওয়ার পর গতকাল তা স্বাক্ষরের জন্য পাঠানো হয়।
এদিকে নিম্ন আদালত থেকে আড়াই মাসেও পি কে হালদারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি না হওয়ায় বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল অসন্তোষ প্রকাশ করেন। আদালত বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। আড়াই মাস হয়ে গেল, গ্রেপ্তারি পরোয়ানার একটা আদেশ হলো না। এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’ আদালত দুদকের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারীরা যত বড় রুই-কাতলা হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের ছাড় দিলে চলবে না।’
পি কে হালদারকে ধরতে দুদকের নেওয়া পদক্ষেপ লিখিতভাবে জানানোর পর গতকাল সকালে উচ্চ আদালত উল্লিখিত মন্তব্য করেন। আদালতে দুদকের প্রতিবেদন দাখিল করেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
এদিকে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে বিচারিক আদালতের প্রতিবেদন, মামলার এফআইআর ও সম্পত্তি-অর্থ জব্দের আদেশ হাইকোর্টে দাখিল করতে দুদককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে এসব প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য ৯ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন।
প্রসঙ্গত, এই হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৯ নভেম্বর পি কে হালদারের বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দেন। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও দেশ থেকে পালানো প্রশান্ত কুমার হালদারকে গ্রেপ্তার করতে বা দেশে ফেরাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা ১০ দিনের মধ্যে জানাতে স্বরাষ্ট্রসচিব, দুদক চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলার প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়। ‘পি কে হালদারকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবে দুদক’ শিরোনামে গত ১৮ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে এই আদেশ দেন আদালত।
ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল দুদক থেকে একটি প্রতিবেদন উচ্চ আদালতে দাখিল করা হয়। তাতে বলা হয়, পি কে হালদারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়েছে। ইন্টারপোলের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে। এটা দেখার পর আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করে দুদকের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘বিচারককে (নিম্ন আদালত) বলবেন, এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’
আদালত বলেন, ‘যারা দুর্নীতিবাজ, যারা অর্থ পাচার করে তাদের ছাড় দিলে চলবে না। তারা যাতে আইনের জালে ধরা পড়ে, সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। যারা আইনের জালে আটকে যায় তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের সবার উচিত হলো, দেশের সম্পদ রক্ষা করা। এটা শুধু কোর্ট করবেন অন্যরা করবে না, তা তো নয়। সবাইকে করতে হবে।’
পি কে হালদার নিরাপদে দেশে ফিরে যাতে আদালতের হেফাজতে যেতে পারেন সে জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা চেয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর আবেদন করে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল)। আবেদনে বলা হয়, ২৫ অক্টোবর তিনি দেশে ফিরতে চান। এই আবেদনে হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চ গত ২১ অক্টোবর এক আদেশে দেশের বিমানবন্দরে পা রাখা মাত্র পি কে হালদারকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন, কিন্তু পি কে হালদার নির্ধারিত দিনে দেশে ফেরেননি।
এর আগে হাইকোর্ট গত ১৯ জানুয়ারি এক আদেশে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, এমডি, বহুল আলোচিত পি কে হালদারসহ ১৩ পরিচালকের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ এবং সব সম্পদ ক্রোক করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে পি কে হালদারের মা, স্ত্রী, ভাইসহ ২০ জনের ব্যাংক হিসাব ও পাসপোর্ট জব্দ এবং সব সম্পদ ক্রোক করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পি কে হালদারসহ এই ২০ জনের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং তাঁদের গত পাঁচ বছরের আয়কর রিটার্ন হাইকোর্টে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের সাতজন আমানতকারীর এক আবেদনে এই আদেশ দেন হাইকোর্টের কম্পানি আদালতের বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার। এই আদেশ স্থগিত চেয়ে আইএলএফএসএলের দুই পরিচালক আপিল বিভাগে আবেদন করলেও আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। এরই মধ্যে পি কে হালদার দেশ থেকে পালিয়ে যান। এ অবস্থায় পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক।