মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

বার্সেলোনা ছাড়তে চান মেসি, হতভম্ব ফুটবলবিশ্ব

প্রকাশিত: ০৬:২৯ এএম, আগস্ট ২৭, ২০২০

বার্সেলোনা ছাড়তে চান মেসি, হতভম্ব ফুটবলবিশ্ব

খেলা ছাড়া দূরের কথা, বার্সেলোনার সঙ্গেও আনুষ্ঠানিকভাবে ছাড়াছাড়ি হয়নি। শুধু ক্লাব কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন ‘এই ক্লাবে আর নয়’। একটি ফ্যাক্সবার্তাতেই কেঁপে ওঠে ফুটবলবিশ্ব। স্পেনের দৈনিক দেপোর্তিভো মুন্দোর প্রধান শিরোনামে যে ছবি ফুটেও উঠেছে, ‘মেসি বোমা; তিনি যেতে চান’। কোথায় যাবেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি, তা এখনো অজানা। তবে তিনি বার্সেলোনা ছাড়তে চেয়েছেন, এটি যেন তাঁর নতুন ঠিকানা জানার চেয়েও বড় খবর। পেশাদার দুনিয়ায় ঠিকানা বদল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো দল বদলে জুভেন্টাসে গেলে মনোবেদনা হয় শুধু রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের। কিন্তু তিনি যে বার্সার লিও, কৈশোর থেকে লা মাসিয়ায় ফুটবলের পরের ধাপে উত্তরণ এবং বিনিময়ে বিস্ময়কর সাফল্যে হয়ে উঠেছিলেন ক্লাবটির প্রতীক। তাই ফুটবলার মেসির ‘আঁতুড়ঘর’ ছেড়ে যাওয়ার বিস্ফোরক খবরে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশও। ফুটবলের সামান্য খোঁজখবর রাখেন যাঁরা, তাঁদের ফেসবুক টাইমলাইনেও মেসির বার্সেলোনা ছেড়ে যেতে চাওয়া নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অন্য কোনো ক্লাবের জার্সিতে মেসিকে মানাবে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে ভক্তমহলে। বিস্ময়কর! এমন নয় যে আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর মতো আর্জেন্টিনা ছেড়ে স্পেনের জার্সি গায়ে চড়াতে চাইছেন মেসি। কিংবা লুইস ফিগোর মতো বার্সা ছেড়ে চিরশত্রু রিয়ালে নাম লিখিয়েছেন। এখনো তো কেউই জানে না নতুন মৌসুমে কোন ক্লাবে দেখা যাবে মেসিকে। শুধু বার্সায় থাকবেন না জানিয়েই ঝড় তুলেছেন। কারণও আছে। বুয়েনস এইরেস থেকে রোসারিও ঘুরে দেখেছি, মেসিকে নিয়ে মাদ্রিদবাসীদের মাঝে বেশি আলোচনা হয়! অবশ্য বোধগম্য কারণেই মাদ্রিদের আলোচনায় মেসি বিদ্বেষ কিংবা ঈর্ষার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকেন। কিন্তু আর্জেন্টিনায় মেসি যেন দূরদেশের রাজকুমার! শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি কিন্তু একেবারে আপনার নয়। ভাবা যায়, ১৭৮ বর্গকিলোমিটারের একটা শহরে মেসি নামক এক বরপুত্রের জন্মস্থান খুঁজে দিতে পারে না কেউ! উল্টো কেন এত দূর থেকে গিয়ে মেসির ছেড়ে যাওয়া পোড়ো বাড়ি খুঁজছি, তা নিয়ে বিরক্ত ডিয়েগো ক্রসিয়ানি আর বিস্মিত আরিয়েল কোলম্যান। ছোট্ট করে দুজনের পরিচয় মনে করিয়ে দেওয়া ভালো। ক্রুসিয়ানি একদা বাংলাদেশ ফুটবল দলের কোচ ছিলেন। আর কোলম্যান ট্রেনার, সেই সূত্রে বাংলাদেশকে ‘সেকেন্ড হোম’ মনে করেন তিনি। তো, অলিম্পিক শেষে বুয়েনস এইরেসে পা রেখে ক্রুসিয়ানিকে ফোনে পাওয়া গেলে পর্যটকের আগ্রহ শুনে তিনি মহাবিরক্ত, ‘তুমি মেসির বাড়ি দেখতে এসেছ? ধুর! মেন্দোসায় আসো। আমি খেলা দেখার ব্যবস্থা করে দেব।’ ২০১৬ আগস্টের ওই ম্যাচটি আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ের রাশিয়া বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের, যে ম্যাচ দিয়ে স্বল্পকালের অবসর ফেলে মাঠে ফিরেছিলেন মেসি। দলও জিতেছিল তাঁর গোলে। স্বভাবতই পত্রিকার প্রথম পাতাজুড়ে মেসির ছবি। কিন্তু কোথায় যেন সামান্য ঘাটতি। বুয়েনস এইরেস থেকে বাসে আড়াই ঘণ্টার পথ রোসারিও। মেসির শহর থেকে প্রায় সমদূরত্বে কোলম্যানের শহর, হুনিন। নিজের গাড়ি নিয়ে ভদ্রলোক এসেছেন তাঁর সেকেন্ড হোমের এক অভিবাসীর ভাষাগত সমস্যা দূর করতে। কিন্তু মেসির জন্মনিবাসে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেই তিনি হাসেন, ‘কী আছে দেখার? তার চেয়ে চলো চে গুয়েভারার জন্ম যে বাড়িতে, সেটা দেখে আসি।’ ওটা দেখেছি, ঘুরেছি আট বছরের মেসি যে ক্লাবের (নিউয়েলস ওল্ড বয়েজ) কিশোর ফুটবলে ঝলক দেখিয়ে বার্সেলোনার একাডেমি লা মাসিয়ায় ‘লাইফলাইন’ পেয়েছিলেন। পর্তুগালে রোনালদোর যে কদর, অতটা মেসির নয় আর্জেন্টিনায়। আবার একটা জায়গায় মেসির ধারেকাছেও নেই রোনালদো; ক্লাব সমর্থকদের ভালোবাসা। মেসির অন্তঃকরণে বার্সা এবং বার্সারও নিউক্লিয়াস মেসি। কাতালুনিয়ার স্বাধিকার আন্দোলনে বার্সেলোনার প্রভাব রয়েছে। সে সূত্রে মেসিও তো গাঁথা! আশ্চর্য যোগসূত্র। রোসারিওর আকাশেই উড়েছিল আর্জেন্টিনার প্রথম পতাকা। একই শহরে জন্ম বিপ্লবী চে গুয়েভারার। এঁদের সবারই স্মারক আছে দর্শনীয় স্থানে। মেসি আছেন শুধু নিউয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাবের একাডেমির দেয়ালে গ্রাফিতি হয়ে। এমন গ্রাফিতি তো বার্সেলোনার প্রতিটি সমর্থক পাঁজরে নিয়ে ঘোরেন। নইলে মেসির বার্সায় থাকতে না চাওয়ার খবরে এমন ঝড় ওঠে নাকি? গড়াতে পারে আদালত পর্যন্ত লিওনেল মেসি বার্সেলোনা ছাড়তে চাইছেন। ক্লাব বলছে, ২০২১ পর্যন্ত চুক্তি আছে তাঁর, এখন গেলে রিলিজ ক্লজের পুরো ৭০০ মিলিয়ন ইউরোই দিতে হবে। কিন্তু মেসি তাঁর চুক্তির একটি ধারা কাজে লাগাতে চাইছেন। যেখানে বলা আছে, প্রতি মৌসুম শেষে চাইলে বিনা মূল্যেই ক্লাব ছাড়তে পারবেন তিনি। সেটি উল্লেখ করেই বার্সায় ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন তিনি। কিন্তু ক্লাব বলছে সেই ধারা অকার্যকর হয়ে গেছে গত ১০ জুন। স্বাভাবিক নিয়মে এই সময়ের মধ্যেই মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। চুক্তিপত্রে তাই সেটিই উল্লেখ করা। কিন্তু এবার করোনায় মৌসুম আগস্ট পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হওয়ায় মেসির আইনজীবীরা মনে করছেন সুযোগটা এখনো নিতে পারেন মেসি। জানা গেছে, বার্সেলোনা ও ফিফার যে কাগজগুলোতে সই করেছেন তিনি, সেখানে মৌসুম শেষ বলতে মৌসুমের শেষ ম্যাচটির কথা উল্লেখ আছে। যদিও বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত ১০ জুনের সময়সীমাই বহাল থাকবে আইনি লড়াইয়ে। ক্লাবের সাবেক সভাপতি হুয়ান গাসপার্তও সে রকমই বলছেন, ‘মেসি এখন যেতে পারবে না। ২০২১-এই তাঁকে যেতে হবে। আমি চুক্তিপত্রটা দেখেছি, ওখানে পরিষ্কার বলা আছে শর্তটা ১০ জুন পর্যন্ত প্রযোজ্য। ফ্রিতে যেতে হলে ওকে তাই পরের মৌসুমেই যেতে হবে। এখন হলে ৭০০ মিলিয়ন ইউরোর কমে হবে না। ক্লাবের হাতে সব কিছু।’ দুই পক্ষ যদি সমঝোতায় না আসে তাহলে শেষ পর্যন্ত হয়তো কোর্ট অব আরবিট্রেশন ফর স্পোর্টসে যেতে হবে মীমাংসার জন্য। ভাবা যায়, মেসি আর বার্সেলোনা সমঝোতার পথ খুঁজতে আদালতের দ্বারস্থ! এরপর কোথায়? গত কিছুদিনে লিওনেল মেসি কয়েকবার ফোন করেছেন গার্দিওলাকে। আলোচনাটা হয়ত শুধু ফোনে আটকে থাকছে না। বার্সেলোনা ছাড়তে চান জানানোর পর মেসিকে পাওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটিই। গত কয়েক বছর বার্সেলোনার হাঁড়ির খবর বিশ্বস্ততার সঙ্গে জানিয়ে এসেছেন এস্পোর্তে ইন্তারতিভো ও রেডিও ইতাতিয়াইয়ার সাংবাদিক মার্সেলো বেকলার। মেসির পরবর্তী গন্তব্য গার্দিওলার তাঁবুতেই দেখছেন তিনি। শুধু গার্দিওলা নন, সিটিতে আরো আছেন বার্সার সাবেক দুই কর্তা—ক্রীড়া পরিচালক তিক্সিকি বেগিরিস্তেইন ও প্রধান নির্বাহী ফেরান সোরিয়ানো। প্রিয় বন্ধু সের্হিয়ো আগুয়েরো তো আছেনই। গতকাল টিওয়াইসি স্পোর্টস জানিয়েছে, দুই বছরের চুক্তির আলোচনা করতে মেসির বাবা জর্জ পৌঁছে গেছেন ম্যানচেস্টারে। ম্যানসিটির সঙ্গে ইন্টার মিলান, পিএসজি, ম্যানইউও যোগ দিয়েছে মেসিকে পাওয়ার দৌড়ে। পিএসজিতে নেইমার, কিলিয়ান এমবাপ্পে, দি মারিয়ার মতো তারকার সঙ্গে খেলতে চাইবেন যে কেউ। তবে উয়েফার ‘ফিন্যানশিয়াল ফেয়ার প্লে’র জন্য মেসির ফ্রান্সে আসা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে ইংল্যান্ডের ডেইলি মেইল। ১০৬ মিলিয়ন ইউরো বেতন দিয়ে মেসিকে উড়িয়ে আনার সামর্থ্য আছে ম্যানইউর। এদিকে ইন্টার মিলান এরই মধ্যে চেষ্টা করেছে মেসিকে কেনার। মেসির বাবা নাকি মিলান শহরে বাড়িও কিনেছেন একটা! তোপের মুখে বার্তোমেউ লিওনেল মেসির ফ্যাক্স বার্তা পেয়ে রাতেই জরুরি সভায় বসেছিল বার্সেলোনা বোর্ড। বাইরে ততক্ষণে কয়েক শ সমর্থক জড়ো হয়ে গেছে। ন্যু ক্যাম্পের সামনের রাস্তায় তারা চিত্কার করছে, ‘মেসি থেকে যাও’, ‘বেরোও বার্তোমেউ’। মেসি তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টাতেও পারেন—এই ধারণা হয়েছে সমর্থকদের যদি বার্তোমেউ পদত্যাগ করেন। সামনের নির্বাচনে বার্তোমেউয়ের প্রতিপক্ষ ভিক্টর ফন্টও তাই বলেছেন, ‘মেসিকে রাখার চেষ্টা করলে বার্তোমেউকে যেতে হবে আগে।’ আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ইহোর্দি ফ্যারে ক্লাবে আনুষ্ঠানিকভাবে বার্তোমেউয়ের বিপক্ষে ‘না’ ভোট আয়োজনের চিঠিও দিয়েছেন। ক্লাবের নতুন স্পোর্টিং ডিরেক্টর অবশ্য জানিয়েছেন, মেসিকে ধরে রাখার চেষ্টাই করছেন তাঁরা। এদিকে কাতালুনিয়া রেডিও জানিয়েছে, গতরাতে খোদ বার্তোমেউয়ের সরাসরি দেখা করার কথা লিওনেল মেসির সঙ্গে। এই কিংবদন্তিকে থেকে যাওয়ার অনুরোধও নাকি করবেন তিনি।
Link copied!