বিষের জন্য খ্যাতি মূলত সাপেরই। তবে নানা জাতের বিছা, মাকড়সা ইত্যাদিরও বিষ ছড়ানোর ক্ষমতা আছে। প্রাচীনকাল থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রে এসবের ভীষণ কদর। প্রথম দিকে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র মূলত ভেষজ উপাদানের ওপরই জোর দিয়েছিল। তবে এখন ঝুঁকছে বিষাক্ত প্রাণীদের দিকেও। ফলও মিলতে শুরু করে দিয়েছে এরই মধ্যে; এমনকি করোনা মোকাবেলায়ও অনেক বিজ্ঞানী হাত বাড়িয়েছেন প্রাণীজগতের প্রতি। লিখেছেন নাবীল অনুসূর্য
ব্রেন স্ট্রোকে নয় অসহায়
ব্রেন স্ট্রোক হলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল হঠাৎ করেই কমে যায়। দেখা দেয় অক্সিজেন স্বল্পতা। তা থেকে মৃত্যু। বেঁচে গেলেও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিষ্ক। মৃত্যুর সংখ্যায় এটা বিশ্বের দ্বিতীয় ভয়ংকর রোগ। প্রতিবছর মারা যায় ৬০ লাখের মতো মানুষ। আরো প্রায় ৫০ লাখ বেঁচে গেলেও বরণ করেন পঙ্গুত্ব। এখন পর্যন্ত এর কোনো চিকিৎসা নেই। রক্ত জমাট বেঁধে গেলে প্রতিকারের জন্য একটা ওষুধ আছে শুধু; কিন্তু মস্তিষ্কের ক্ষতির কোনো প্রতিকার নেই।
তবে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট গ্লেন কিং আশার আলো দেখাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আছে প্রাণীদের বিষের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ। এর একটি প্রতিকার করতে পারবে ব্রেন স্ট্রোকের, দাবি কিংয়ের। অস্ট্রেলিয়ার এক প্রজাতির মাকড়সার বিষ। মাকড়সাটি পরিচিত ডারলিং ডাউনস নামে। কিংয়ের মতে, এর বিষ ‘বিশ্বের সবচাইতে জটিল রাসায়নিক মিশ্রণ’।
২০১৭ সালে এ নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন তিনি। তাতে দাবি করেছেন, আক্রান্ত হওয়ার আট ঘণ্টার মধ্যে এটি প্রয়োগ করতে পারলে মস্তিষ্কের ক্ষতির অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর চার ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োগ করলে প্রতিরোধ করা যাবে ৯০ শতাংশ। আর সামান্য পরিমাণেই কাজ হয়ে যাবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কাও কম। কারণ বেশির ভাগ মাকড়সার বিষই মানুষের ক্ষতি করে না।
এই মাকড়সার বিষের আরেক সম্ভাবনার কথাও বলেছেন কিং। মৃগী রোগের অন্যতম ভয়ংকর ধরন ড্র্যাভেট সিনড্রোম। সাধারণ মৃগীর তুলনায় এতে মৃত্যুর হার ৩০ গুণ বেশি। এর প্রতিকারেও এই বিষ ব্যবহারে ভালো ফল মিলবে বলে আশা করছেন তিনি।
ক্যান্সার হবে জয়
ক্যান্সার চিকিৎসার অন্যতম জটিল প্রক্রিয়া হলো আক্রান্ত কোষগুলোকে সুস্থ কোষ থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করা। সেটা ঠিক মতো করতে না পারলে ভীষণ বিপদ। দেখা যাবে, ডাক্তাররা ভেবেছেন অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। কিন্তু ভেতরে ক্যান্সারের কিছু কোষ থেকে গেছে। সেটা থেকে আবারও তা ছড়িয়ে পড়বে, বিশেষ করে মস্তিষ্কের টিউমারের অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে এমনটা হলে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হয়ে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই ২০০৪ সালে মার্কিন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ জিম ওলসন কাজে নামেন। এমন একটি উপাদান খুঁজছিলেন, যেটা প্রয়োগ করলে আক্রান্ত কোষগুলোকে সহজেই চিহ্নিত করা যাবে। মাত্র দেড় মাসের চেষ্টায়ই সফল হন। ভয়ংকর এক বিছার বিষ। বিছাটি এতই ভয়ংকর যে সেটার নামই ‘ডেথস্টকার’। অবশ্য এর ছয় বছর আগেই ব্রেন টিউমারের চিকিৎসায় এর প্রয়োগের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন আলাবামার কিছু গবেষক। এটা প্রয়োগ করলে এমআরআই স্ক্যানে আক্রান্ত কোষগুলো ৫০০ গুণ বেশি সংবেদনশীল হিসেবে দেখা যায়।
ব্রেন টিউমারের চিকিৎসার মতো অন্যান্য ক্যান্সারের চিকিৎসায়ও এই বিষ নির্ঘাত কার্যকর হবে, এই বিশ্বাসে কাজ করছে বিজ্ঞানীদের বেশ কয়েকটি দল। ওদিকে অন্য বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন এমন উপাদান, যেগুলো সরাসরি ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলোকে ধ্বংস করবে। প্রাপ্তির ঘরও নিতান্ত শূন্য নয়। অস্ট্রেলিয়ার বেরঘোফের রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক মারিয়া ইকোনোমোপুলু তেমনি সুখবর দিয়েছেন ২০১৮ সালে। ব্রাজিলের এক জাতের বিষাক্ত মাকড়সার বিষ স্কিন ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করে। পরে দেখিয়েছেন, প্রায় একই রকম কার্যকর ডারলিং ডাউনস মাকড়সার বিষও।
করোনাভাইরাস মোকাবেলার আশা
প্রাণীদের বিষ কার্যকর হতে পারে নতুন-পুরনো বহু রোগের চিকিৎসায়। বায়োকেমিস্টদের মতে এগুলো সব সোনার খনি। প্রাণীদের স্নায়ুতন্ত্র নিয়েই এদের কাজ। হাজার বছরের বিবর্তনে এগুলোর ফর্মুলা ভীষণই সমৃদ্ধ। এর মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিত্যনতুন সম্ভাবনার দুয়ার খোলা সম্ভব। হচ্ছেও তাই। তেমনটা অসম্ভব নয় কভিড-১৯ মোকাবেলায়ও। এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন অনেক বিজ্ঞানী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে তেমনই এক গবেষণা করছেন প্রোটিন বিশেষজ্ঞ জ্যাখারি ক্রক। তিনি এমন এক উপাদান খুঁজছেন, যেটা শরীরে প্রবেশ করে করোনাভাইরাসকে আক্রমণ করবে। সে জন্য চষে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন প্রাণীর বিষের তথ্যভাণ্ডার। প্রকৃতিতে যে ভাইরাসের জন্ম, তার প্রতিষেধকও নিশ্চয় প্রকৃতিতেই মিলবে। তবে উল্টো পিঠে হতাশার কথাও আছে। মানুষের কারণেই পৃথিবীতে প্রাণীবৈচিত্র্য কমছে। সেই সঙ্গে কমছে বিষের বৈচিত্র্য। অনেক প্রাণী তথা বিষ হারিয়ে গেছে মানুষ সেগুলো নিয়ে গবেষণা করার আগেই। কয়েক মাস ধরে বিশ্বজুড়ে মানুষকে অনেক শিক্ষাই দিচ্ছে করোনাভাইরাস। এই আরেক শিক্ষা। নিজেদের প্রয়োজনেই প্রাণীজগতের বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে মানুষকে।