ডেইলি খবর ডেস্ক: ফরিদপুরের শহরে যারা এক সময় চটি পরে হাঁটতেন,রিকশা ভাড়াও দিতে পারতেন না, চলতেন অন্যের মোটরসাইকেলে। নেতাদের টেবিলে টেবিলে খাবার এগিয়ে দিতেন। তাদের কেউ কেউ যেন রাতারাতি আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান। চটি আর রিকশার পরিবর্তে চড়ে বসেন বিএমডবিøউ-পাজেরোতে। একেবারে কয়েক বছরের মধ্যে হয়ে যান জিরো থেকে হিরো।এ ‘হিরো’ বলতে ঘুস-দুর্নীতির টাকায় রাতারাতি তারা কোটিপতি নয়,শতকোটি টাকার মালিকও বনে গেছেন। এ হিরোরা অবৈধ টাকা আর ক্ষমতার দাপটে ফরিদপুরের মাটিতে এক সময় ভয়ংকর ভিলেন হিসাবে আবির্ভূত হন। যাদের হাতে সাধারণ মানুষ ছাড়াও খোদ আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরাও দফায় দফায় হেনস্তার শিকার হয়েছেন।
প্রতিপক্ষ মনে হলেই হামলা-মামলা দিয়ে সর্বস্বান্ত করা হতো। রেহাই পাননি গণমাধ্যম কর্মীরাও। ফরিদপুরের প্রথিতযশা সাংবাদিকদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে নজিরবিহীন হয়রানি করা হয়েছে। তবে শেষমেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কঠোর অবস্থানের কারণে সেইসব জগদ্দল পাথরের বোঝা এখন অবসান হওয়ার পথে। দুর্বৃত্তদের অনেকেই ধরাশায়ী। হত্যা ও অর্থ পাচারের মামলায় তাদের ঠিকানা এখন কারাগার। শক্ত হাতে একযোগে অবশিষ্ট তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি এবং থানা পুলিশ।
জানা যায়,২০২০ সালের জুনে দুই সহোদর বরকত-রুবেলকে আটকের আগে দুদক তাদের তলব করে। কয়েক দফায় দুদকে হাজির দিয়ে দুই ভাই বুঝতে পারে তাদের ক্ষমতার দিন শেষ। কারণ, দুদক তাদের সব অপকর্মের তথ্য জেনে গেছে। যথারীতি প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে তাদের বিরুদ্ধে আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা করে দুদক। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর দুদক উপ-পরিচালক মো:আলী আকবর বাদী হয়ে মামলা করেন।
অপরদিকে সাবেক মন্ত্রীর এপিএস এ.এইচ.এম ফোয়াদের বিরুদ্ধে ২ হাজার কোটি টাকা অর্থ পাচার,হত্যাসহ মোট আট মামলার মধ্যে সাতটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হাট-বাজার নিয়ন্ত্রণ, জমি দখলসহ নানাবিধ অপরাধ করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।এছাড়া শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ২০১৬ সালের ১২ জুলাই ছোটন হত্যাকান্ডের ঘটনায় আসামি হিসাবে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে আদালত দুই দফায় ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে তার কাছ পুলিশ আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়। ১৩ অক্টোবর ফরিদপুর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
এদিকে এপিএস ফোয়াদ গ্রেফতারের দুদিন পর ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিদেশে যান।সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি থেকে ফোনে তিনি বলেন,আমি বিদেশে (স্থায়ীভাবে) চলে যাইনি। আমি কি আমার ছেলের কাছে, নাতি-নাতনির কাছে বেড়াতে যেতে পারি না? আমার চরম শত্রু (ফরিদপুরে) যারা তারাও কি বলতে পারবে আমি এমপি হয়ে রাজনীতি করে ফায়দা লুটেছি? তারা (সাবেক মন্ত্রীর কাছের অনুসারীরা) যদি কন্ট্রাকটারি করে লুটপাট করে টাকা-পয়সা এনে থাকে তার জন্য কি আমি দায়ী? টেন্ডার দিয়ে কাজ পেয়ে থাকে তাহলে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়াররা এর জন্য দায়ী। তারা যখন রাজনীতি করে ফায়দা লুটেছে তখন তো আপনারা তা কোনো কাগজে লেখেননি। এ ছাড়া বর্তমানে ফরিদপুরে এখন আর রাজনীতির পরিবেশ নেই। তাই ফরিদপুরের রাজনীতির সঙ্গে আমি নেই।জানা যায়,ফরিদপুরে শুদ্ধি অভিযান শুরু হলে প্রথমে দুই ভাই বরকত ও রুবেল পুলিশের হাতে আটক হয়। এরপর দুই ভাইসহ একে একে কমবেশি ২৫ নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এর মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার মামলায় সিআইডি ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশের আদালতে ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন।এরা হলেন-খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর,এপিএস এএইচএম ফোয়াদ, শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খন্দকার নাজমুল হাসান লেভি, শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত,তার সহোদর প্রেস ক্লাবের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেল,শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ফারহান,জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ফাহিন,শহর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল হাসান ডেভিড, মোহাম্মাদ আলী মিনার ও তারিকুল ইসলাম নাসিম।
এদের মধ্যে বর্তমানে ৫ জন কারাগারে আছেন। বাকি ৫ জনের মধ্যে খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর, ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ফাহিম, কামরুল হাসান ডেভিড,মুহাম্মদ আলি মিনার এবং তারিকুল ইসলাম নাসিমের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।এ ছাড়া আরও ৪২ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় তদন্ত চলছে। যারা আসামিদের সহযোগী। অভিযোগপত্রে বলা হয়,তদন্তে এদের বিরুদ্ধে সহযোগিতার প্রমাণ পেলে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।বরকত ও রুবেলসহ তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ঢাকার কাফরুল থানায় মামলা হয়েছে। মামলা করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাস। এ মামলায় দুই ভাই ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে ২ হাজার কোটি টাকা উপার্জন ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়। সিআইডির দায়েরকৃত এ মামলায় বলা হয়,২০১০ সাল হতে ১০ বছরে এলজিইডি, বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন বরকত ও রুবেল। মাদক ব্যবসা এবং ভূমি দখলেরও অভিযোগ আনা হয়।
এছাড়া এ মামলায় সিআইডির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বরকত-রুবেল ও তাদের স্বজনদের ৪৮৭টি তফসিলে থাকা ৫ হাজার ৭০৬ বিঘা জমি, ৮৮টি ব্যাংক হিসাবে থাকা প্রায় পৌনে ১০ কোটি টাকাসহ তাদের ৫৫টি বাস-ট্রাক,বিএমডবিøউ গাড়ি,মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকার ক্রোকের আদেশ দেন আদালত। এর আগে গত বছরের ৯ অক্টোবর একই আদালত বরকত ও রুবেলসহ বরকতের স্ত্রী আফরোজা আক্তার,রুবেলের স্ত্রী সোহেলী ইমরোজ পুনম এবং শ্বশুর আবদুল খালেকের নামে থাকা ৮৮টি ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দেন।দুই ভাই বরকত ও রুবেলের বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক মো:আলী আকবর বলেন,‘মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট পুরাতন কাগজপত্র আগেই পেয়েছি। কিছু নতুন তথ্য সংবলিত কাগজপত্র হাতে এসেছে। আমাদের তদন্ত কাজ নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করতে হয়। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তদন্তের স্বাভাবিক গতি কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছে। তবে দ্রæততম সময়ের মধ্যে তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।’এ বিষয়ে পুলিশ সুপার মো:আলিমুজ্জামান-বিপিএম বলেন,দুর্নীতিবাজদের অনেকে আটক হয়েছে,বাকিদের আটকের জন্য পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরও অনেককে খোঁজা হচ্ছে।সুত্র-যুগান্তর