যুদ্ধ-সংঘাত পরিহার করে মানবকল্যাণে কাজ করুন: জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী
প্রকাশিত: ১২:১৬ এএম, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৩
ডেইলি খবর ডেস্ক: বিশ্ব নেতাদের যুদ্ধ-সংঘাতের পথ পরিহার করে শান্তি, মানবজাতির কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার (সেপ্টেম্বর ২২) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজ আপনাদের সকলের কাছে, বিশ্ব নেতাদের কাছে আমার আবেদন, যুদ্ধ, স্যাংশন ও সংঘাতের পথ পরিহার করুন এবং আমাদের জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী শান্তি, মানবজাতির কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করুন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭৫ সালে এক রাতে পরিবারের সবাইকে হারানোর কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমি নিজে নিপীড়িত এবং যুদ্ধ ও হত্যার নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যুদ্ধ, হত্যা, অভ্যুত্থান ও সংঘাতের ভয়াবহতার কারণে মানুষ যে বেদনা ও যন্ত্রণা সহ্য করে তা অনুভব করতে পারি।
বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতার সমালোচনা করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও বৈধতা নিয়ে মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। এর ফলে একটা শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অর্জিত সাফল্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় সকলকে এক যোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলের জন্য নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য অভিন্ন সঙ্কট মোকাবিলায় আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ জন্য, আমাদের অবশ্যই বিভাজন, সঙ্কীর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতার বিপরীতে একতা, সহমর্মিতা ও বহুপাক্ষিকতা বেছে নিতে হবে। তিনি বলেন, শান্তি ও টেকসই সমৃদ্ধি অর্জনের উদ্দেশ্যে আমাদের অবশ্যই সুবিচার, ন্যায় ও ন্যায্যতার নীতি অনুসরণ করতে হবে, যার ভিত্তি হবে জাতিসংঘ সনদ এবং ২০৩০ এজেন্ডা।
বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ এবং তৎসংশ্লিষ্ট হুমকি নিয়ে চিন্তিত; যা প্রতিনিয়ত তথ্যের অপব্যবহার এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুনভাবে আবির্ভূত হচ্ছে। আমার সরকার চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে “শূন্য সহনশীলতা” নীতি গ্রহণ করেছে। আমরা কখনই সন্ত্রাসবাদ কার্যক্রম সংঘটনে বা অন্যের ক্ষতি সাধনে আমাদের ভূমি ব্যবহৃত হতে দেই না। তিনি বলেন, যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অস্থিরতা, বিদ্বেষমূলক এবং উগ্রপন্থী বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। শেখ হাসিনা বলেন, সাম্প্রতিককালে পবিত্র কুরআন শরীফ পোড়ানোর মত জঘন্য অপরাধ আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এ ধরনের জঘন্য অপরাধ শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকেই আঘাত করে না, এটি অস্থিরতাকে উসকে দেয় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্থ করে।
বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পাশে থাকবে জানিয়ে ফিলিস্তিন ইস্যুতে শেখ হাসিনা বলেন, এ বছর ফিলিস্তিনের উপর বিপর্যয় নিয়ে আসা - ‘নাকবা’ এর ৭৫ বছর পূর্ণ হলো। ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ অধিকার অর্জনের পথ এখনও আশার মুখ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিনের জনগনের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পাশে থাকবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচূত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। গত মাসে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচূত হওয়ার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আমরা অস্থায়ীভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু, পরিস্থিতি এখন আমাদের জন্য সত্যিই অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতি সম্ভাব্য মৌলবাদকে ইন্ধন দিতে পারে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। তিনি বলেন, বাস্তুচূত রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় এবং সেখানে তারা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আগ্রহী। আসুন আমরা এই নিঃস্ব মানুষের জন্য তাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করি। ‘ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ’ অকার্যকর হয় পড়েছে জানিয়ে এ ব্যবস্থার দ্রæত পুনরুদ্ধারের জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলকে আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের মত দেশগুলোর জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে সারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া, উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণের লক্ষ্যে হিমাগার নির্মাণের জন্য আমাদের বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। আমি জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য আঞ্চলিক 'খাদ্য ব্যাংক' চালু করার প্রস্তাব করছি। আমাদের অবশ্যই জলবায়ু-সহনশীল ফসলের গবেষণায় একে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কম সুদে ঋণ সহায়তা দিতে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, এমন একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক অবকাঠামো আমাদের জরুরিভাবে প্রয়োজন যা উন্নয়নশীল দেশগুলিকে বিশেষ ছাড়ে, কম খরচে, কম সুদে এবং ন্যূনতম শর্তে অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, জরুরি অবস্থা এবং দুর্যোগের সময় আইএমএফের এসডিআর তহবিলে উন্নয়নশীল দেশগুলির ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার থাকতে হবে। সমস্ত ঋণ ব্যবস্থায় প্রাাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত বিশেষ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। শেখ হাসিনা আরও বলেন, ৫০০ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রণোদনা প্যাকেজ প্রস্তাবনার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আমরা এই প্রস্তাবনার দ্রæত বাস্তবায়ন দাবি করছি।