মঙ্গলবার, ০১ জুলাই, ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

সক্রিয় আন্তর্জাতিক চক্র: নারী পাচারে ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বার

প্রকাশিত: ১২:০৫ পিএম, জুন ২১, ২০২১

সক্রিয় আন্তর্জাতিক চক্র: নারী পাচারে ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বার

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে দীর্ঘ ৪ দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে নারী পাচার হচ্ছে। ক্ষমতার পালাবদল হলেও সীমান্ত এলাকার প্রভাবশালী কয়েক ব্যক্তিকে এ কাজ থেকে কেউ বিরত রাখতে পারেনি। বরং সময়ে সময়ে যোগ হয়েছে নতুন নাম। সম্প্রতি ভারতে নারী পাচারের আন্তর্জাতিক চক্রের তথ্য এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। দেখা গেছে, ওই চক্রে রয়েছে যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও নড়াইল- চার জেলার বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধিও (ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বার)। এসব জেলা দিয়ে পার করা নারীদের এরা ভারতের কলকাতা, কেরালা, বেঙ্গালুরু ও চেন্নাইয়ে পাঠাত। ভারতে এক তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর নারী পাচারের ঘটনায় পাঁচটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিনটি মামলায় বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নজরদারিতে রয়েছে চক্রের আরও অন্তত অর্ধশত সদস্য। এরমধ্যে অর্ধডজনকে যে কোনো সময় গ্রেফতার করা হতে পারে। আর ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন ১২ জন। এদের মধ্যে একজন ছাড়া সবাই বাংলাদেশি। এ ১২ জনের মধ্যে ১০ জনই ভারতের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বাংলাদেশে গ্রেফতার ব্যক্তিদের আটজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামিদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্র। ভারতে অবস্থানরত সবুজ এক চক্রের হোতা। তার হয়ে দেশে সমন্বয়কের কাজ করত টিকটক হৃদয় বাবু ও পঞ্চম শ্রেণি পাশ নদী আক্তার। আর সাতক্ষীরা সীমান্তের ধাবকপাড়ার কালিয়ানির স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধিসহ বেশ কয়েকজন তাদের এ কাজে সহযোগিতা করত। এ জনপ্রতিনিধিদের বিষয়ে এক আসামির বক্তব্য হলো- ‘তাদেরকে মন্ত্রী বানানোর কথা বললেও তারা হবে না। তারা ওখানকার চেয়ারম্যান বা মেম্বারই থাকবে। ওখানের মতো এত টাকা কোথাও উড়ে না।’ জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ভারতে নারী নির্যাতন ও নারী পাচারের ঘটনায় উভয় দেশেই মামলা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতারে ভারতীয় পুলিশ আমাদের সহযোগিতা করছে। আমরাও এ বিষয়ে আমাদের কাছে থাকা তথ্য তাদের দিচ্ছি- যাতে চক্রের হোতাদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনা যায়। পাশাপাশি ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে নির্যাতনের শিকার তরুণী ও এ ঘটনায় জড়িতদের দেশে আনতে পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখার মাধ্যমে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ১ জুন হাতিরঝিল থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি মামলা হয়। সেই মামলায় গ্রেফতার সাতক্ষীরার মো. আমিরুল ইসলাম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আকবর আলী নামের এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন। আমিরুল মোটরসাইকেল ভাড়ায় চালান বলে জানান। তিনি বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামানের পালিত ছেলে আব্দুস সালাম মেয়েদের ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে পাচার করে। তার কথামতো আমি প্রায়ই মেয়েদের মোটরসাইকেলে ভারতীয় সীমান্তে মেহেদী হাসান বাবুর কাছে পৌঁছে দিতাম। একজন মেয়ের জন্য আমাকে ২০০ টাকা করে ভাড়া দিত। বাবু ও আলম মেয়েদের বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিয়ে এসে তাদের বাসায় রাখত। সময় বুঝে তারা মোটরসাইকেলে সীমান্তে আনিসুর রহমান আনিসকে বুঝিয়ে দিত ও সীমান্ত পার করে দিত। আকবর আলীকে প্রায় সময় সীমান্তে বসে থাকতে দেখতাম। সে সীমান্তে লাইনম্যান হিসাবে কাজ করত ও বিনিময়ে টাকার একটা ভাগ পেত। এ আকবার আলী সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন মানুষ। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে তিনি ভারতে মানব পাচারে জড়িত বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র। তার নিয়ন্ত্রণে তিনটি ঘাট (পাচারের রুট) রয়েছে। আকবর সম্পর্কে এ চক্রের এক সদস্যের বক্তব্য হলো, ‘তার নিয়ন্ত্রণে থাকা তিন ঘাট দিয়ে একটি পাখি পার হতে হলেও তার অনুমতি লাগে।’ জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক বলেন, নারী পাচারের মূল হোতাসহ পুরো চক্রটিকে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব। এ চক্রের কেউ ছাড়া পাবে না। সীমান্তবর্তী যশোর, সাতক্ষীরা এলাকায় দফায় দফায় আমরা অভিযান চালিয়েছি এবং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। আরেক আসামি মেহেদী হাসান ওরফে বাবুও মানব পাচারের ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনি বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যানের নির্দেশে তার ছেলে ইনজামামুল হক ইনজা, পালিত ছেলে আব্দুস সালাম, মেম্বার ইমরুল ইসলাম, তার চাচা হারুন এই কাজ দেখাশোনা করে এবং টাকার ভাগ পায়। আমি আনিসুরের প্রস্তাবে রাজি হই। আমি এই কাজে যোগ দেওয়ার পর দেখি আনিসুর রহমানের নির্দেশে আব্দুস সালাম, মহিউদ্দিন, শাহীন, মনিরুল, শহিদ ও আমিরুল অবৈধভাবে নারী ভারতে পাচার করে। আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে নারীদের রাখতাম। এরপর তার বর্ণনায় হৃদয় বাবুর নাম উঠে আসে। মেহেদী হাসান বাবু বলেন, হৃদয় বাবুকে আমাদের চেয়ারম্যানের মেহমান হিসাবে আগে থেকে চিনতাম। তিনি একটি মেয়েকে পাচারের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, সেই রাতে পুলিশ আসে। তাদের আসার খবর পেয়ে আমি মেম্বার ইমরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করি। একইসঙ্গে ইনজামামুলের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। তখন সে জানায়, পুলিশ ধরলে যেন বলি তারা চেয়ারম্যানের মেহমান। আরেক আসামি মো. মহিউদ্দিনের বর্ণনাতেও উঠে আসে আকবরের নাম। তিনি সীমান্তে আকবরের কাছে মেয়েদের পৌঁছে দিতেন বলেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন। তিনি এতে আরও বলেন, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামানের ছেলে যেই পথে তারা পাচারে জড়িত তার মূল মালিক। তার জবানবন্দিতে আরও উঠে আসে চেয়ারম্যানের ছেলে ইনজামামুল হক ইনজা, পালিত ছেলে আব্দুস সালাম ও ইমরুল মেম্বারের নাম। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, একবার যশোর সীমান্ত দিয়ে দুই নারীকে পার করার সময় সীমান্তে বিজিবির জেরার মুখে পড়ে চক্রের কয়েক সদস্য। তখন তাদের পাকড়াও করলে তারা ‘ঢাকা থেকে আসা মেম্বারের গেস্ট’ বলে পরিচয় দেয়। পরে মেম্বার গিয়ে তাদের নিজের গেস্ট বলে ছাড়িয়ে নিয়ে সাতক্ষীরা সীমান্তে পাঠায়। এরপর সেই রুট দিয়ে তাদের পাচার করা হয়। যেভাবে পাচার হতো : আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী, পাচারের জন্য নারীদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখানো হতো। এক্ষেত্রে যাদের আর্থিক অসঙ্গতি রয়েছে, তাদের উচ্চ আয়ের প্রলোভন এবং আর্থিকভাবে সচ্ছলদের ‘মডেল’ বানানোর প্রলোভন দেখানো হতো। ভারতে পাঠানোর প্রক্রিয়াটি বিশ্বাসযোগ্য করতে বানানো হতো নানা গল্প। যাওয়ার খরচ বাবদ অনেকের থেকে নেওয়া হতো টাকা। এরপর ঢাকা থেকে নানা কৌশলে নিয়ে যাওয়া হতো সীমান্তে। সেখানে ২ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা হাঁটিয়ে সীমান্ত পার করা হতো। সীমান্তে তাদের ‘পিস’ উল্লেখ করা হতো। সেখানে আধার কার্ড বানিয়ে পাঠানো হতো ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। এরপর তাদের ওপর নেমে আসত নির্মম নির্যাতন। ভারতে এক তরুণীকে নির্যাতনের একটি ভিডিও সম্প্রতি ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের কর্মকর্তারা এর সঙ্গে যুক্ত টিকটক হৃদয় বাবু ও তার সহযোগীদের শনাক্ত করে। পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তারা বেঙ্গালুরু পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখানকার পুলিশ টিকটক হৃদয় বাবুসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করার পাশাপাশি ওই তরুণীকে উদ্ধার করে। এ ঘটনার পর একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে নারী পাচারের তথ্য।
Link copied!