মঙ্গলবার, ০১ জুলাই, ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

সমঝোতায় শান্ত বরিশাল, ক্ষতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০৭:৩৮ এএম, আগস্ট ২৪, ২০২১

সমঝোতায় শান্ত বরিশাল, ক্ষতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগ

প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি বেশ জোরেশোরেই প্রচার করছে বরিশালের আওয়ামী লীগ। রোববার গভীর রাতে বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনে প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পরপরই মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ঘোষণা দেন, ‘সকল সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আমরা সবাই আবার মিলেমিশে কাজ করব।’ রাত দেড়টার দিকে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় সমঝোতার খবর। আওয়ামী লীগ যখন ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করছে সমঝোতার বিষয়টি তখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন প্রশাসনের কর্তারা। সমঝোতার বিষয়ে কোনো কথা বলা তো দূরে থাক, গণমাধ্যমকর্মীদের রীতিমতো এড়িয়ে চলছেন তারা। এই বিষয়টিকেই সন্দেহের চোখে দেখছেন সুশীল সমাজসহ নাগরিক সংগঠনগুলোর নেতারা। তাদের মতে, ১৮ আগস্ট বুধবার রাত থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। দলের ৫ নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছেন। ইউএনও মুনিবুর রহমান ও পুলিশের করা পৃথক দুটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে এখনো জেলহাজতে দলের ২২ নেতাকর্মী। ওই দুই মামলায় আসামি করা প্রায় সাড়ে ৬শ’ জনও ক্ষমতাসীন দলেরই নেতাকর্মী। সবকিছুর বিবেচনায় চার দিনের ঘটনাক্রমে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ। অথচ যে বিষয়টি নিয়ে এতকিছু ঘটল তাতেও তেমন দোষও ছিল না দলটির নেতাদের। এমন পরিস্থিতিতে এই সমঝোতায় কাদের লাভ আর কাদের ক্ষতি হল সেটা নিয়েই চলছে বিশ্লেষণ। রোববার দুপুরে ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম যখন বরিশালের ঘটনাটিকে দুপক্ষের ভুল বোঝাবুঝি আর খুব শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন তখনই পরিষ্কার হয়ে যায় সমঝোতা হতে খুব একটা বাকি নেই। এরপর রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ আসে সমঝোতার খবর। প্রথমদিকে দুপক্ষই তীব্রভাবে চেষ্টা চালান পুরো বিষয়টি গোপন রাখতে। সেই চেষ্টায় প্রশাসন সফল হলেও পিছিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে সমঝোতা বৈঠক শেষে বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল আহসান বাদলের বাসভবনে প্রশাসন আর আওয়ামী লীগ নেতাদের এক সারিতে দাঁড়িয়ে তোলা একটি ছবিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বৈঠকে উপস্থিত একজন সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘সেখানে গিয়েই মনে হয়েছে যে বৈঠক বরিশালে হলেও এর নিয়ন্ত্রণটা বরিশালে ছিল না। যে কোনোভাবেই হোক দুপক্ষের মধ্যে একটা সদ্ভাব তৈরি করতে হবে এ রকম একটা চাপ ছিল ওপর থেকে। সরকারের উপর মহলই চাচ্ছিল না বিষয়টি নিয়ে আর পানি ঘোলা হোক। বৈঠক শেষে হাস্যোজ্জ্বল যে গ্রুপ ছবিটি তোলা হয় সেটিও যেন ছিল দুপক্ষের মিলে যাওয়ার একটি প্রমাণ। যা ওই রাতেই উপর মহলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে এমন আলোচনাও হয়েছে সেখানে। এর মানে হচ্ছে স্থানীয় উদ্যোগে নয়, উপরের চাপে পড়েই আয়োজন হয় ওই সমঝোতা বৈঠকের।’ সমঝোতার বিষয়টি স্বীকার করলেও আওয়ামী লীগ নেতারা একটি বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলছেন না গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে। সেটি হচ্ছে কী কী শর্তের ভিত্তিতে হলো এই সমঝোতা। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড. একেএম জাহাঙ্গীর কেবল বলেছেন, ‘বিভাগীয় কমিশনার আমাদের চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। সেখানে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিলেন। আমাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝির কারণে এই যে বড় ধরনের গোলমাল হলো সেটিও পরিষ্কার হয়েছে দুপক্ষের কাছে। সমঝোতা হয়েছে এ নিয়ে দুপক্ষ ভবিষ্যতে আর বাড়াবাড়ি করবে না।’ তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের সাড়ে ৬শ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে থাকা ২৩ জনের জামিন এবং গুলিবর্ষণে চোখ হারানো দুই নেতাকর্মীর বিষয়ে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘সমঝোতা যখন হয়েছে তখন এসব নিয়ে আর সমস্যা হবে না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ তবে একটু ভিন্ন সুর শোনা গেছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শাহাবুদ্দিন খানের কণ্ঠে। তিনি বলেন, ‘বরিশালের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা আর দুপক্ষের মধ্যে সদ্ভাব ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই রোববার বসেছিলাম আমরা। সেখানে প্রশাসনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের শান্তিপূর্ণ সমঝোতা হয়েছে।’ মামলা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আইনি কাঠামোর মধ্যে রেখেই মামলাগুলোর সমাধান করা হবে।’ এই আইনি কাঠামোর বিষয়টি নিয়েই এখন প্রশ্ন এখানকার নাগরিক সংগঠনগুলোর নেতাদের। বরিশাল প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাড. এসএম ইকবাল বলেন, ‘সমঝোতার কারণে বরিশালে স্বস্তি আর শান্তি ফিরে এসেছে এটা যেমন ঠিক, তেমনি দুপক্ষেরই উচিত ছিল একত্রে একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিষয়টি সবাইকে জানানো। সেক্ষেত্রে আজ যেসব প্রশ্ন উঠছে সেগুলো উঠত না।’ বরিশাল নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘পুলিশ আর প্রশাসন চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটি মামলা হয়ে গেল আওয়ামী লীগের সাড়ে ৬শ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। গ্রেফতার অভিযানও শুরু হয়ে গেল। জেলহাজতে পাঠানো হলো ক্ষমতাসীন দলের ২২ নেতাকর্মীকে। যাদের মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও রয়েছেন। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে দুটি মামলাতেই প্রধান আসামি করা হলো সিটি মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে। অথচ আদালতে ইউএনও মুনিবুর রহমান ও ওসি নুরুল ইসলামসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করতে গিয়ে হোঁচট খেল আওয়ামী লীগ। সেখানে দিনভর কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে সন্ধ্যায় জানানো হলো অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পিবিআইকে। ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পিবিআই তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এই মামলার ব্যাপারে।’ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি অ্যাড. তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘থানায় যাওয়ার পর তারা যখন মামলা নিলেন না তখন বাধ্য হয়ে আমাদের আদালতে যেতে হয়।’ বরিশালের বিশিষ্ট আইনজীবী ও আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে দুটি মামলা হয়েছে সেগুলোতে এমন কিছু ধারা রয়েছে যা সমঝোতার যোগ্য নয়। এক্ষেত্রে দুটি উপায়ে মামলার নিষ্পত্তি হতে পারে। একটি হলো তদন্তকারী কর্মকর্তা সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে পারেন। তবে সমস্যা হলো অভিযোগের ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে ঘটেছে তাই চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল হলে বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। আরেকটি উপায় হলো তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে চার্জশিট দিলেন কিন্তু সাক্ষীরা আসামিদের বিপক্ষে আদালতে কিছু বললেন না। সেক্ষেত্রে এমনিতেই আসামিরা খালাস পেয়ে যাবেন। তবে এটা ঠিক যে, সিটি মেয়রসহ যাদের নাম মামলায় আসামি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের অবশ্যই আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিতে হবে এবং মামলার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ঝামেলা পোহাতে হবে। সেই সঙ্গে গুলিতে যাদের অঙ্গহানি হয়েছে এবং যারা আহত হয়েছেন তাদের স্থায়ী একটা ক্ষতি তো হয়েই গেল।’
Link copied!