ডেইলি খবর ডেস্ক: সুযোগের সদব্যবহার। করোনা মহামারী মোকাবিলয়ায় সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে পাঁচটি হাসপাতাল টাকা খরচে বড় ধরনের অনিয়ম করেছে। দেশের ১২টি হাসপাতালের জন্য সরকারের বরাদ্দ দেওয়া মোট ১৭৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকার মধ্যে হাসপাতালগুলো খরচ করেছে ৬২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এরমধ্যে পাঁচটি হাসপাতাল করোনা মোকাবিলার ওই অর্থ ব্যয়ে কমপক্ষে সাড়ে ৫ কোটি টাকার অনিয়ম করেছে বলে উঠে এসেছে খোদ সরকারি একটি সংস্থার তদন্তে। টাকা খরচে অনিয়মের তালিকায় থাকা এই হাসপাতালগুলো হলো কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল,কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল,মহানগর জেনারেল হাসপাতাল,ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা জেনারেল হাসপতাল।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন,দৈনিক শ্রমিক নিয়োগ, কোয়ারেন্টাইন খাতে ব্যয়,বিধিবহির্ভূত কেনাকাটা,হোটেলে অবস্থানের ক্ষেত্রে প্রকৃত কক্ষ থেকে বেশি কক্ষের ব্যবহার দেখিয়ে ভাড়া পরিশোধ এবং এক কোডের বিল অন্য কোডে ব্যয়সহ সরকারের প্রচলিত বিধিবিধান অনুসরণ না করে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ লোকসান করেছে সংশ্লিষ্টরা। সরকারি বিপুল পরিমাণ এ অর্থ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আদায় করারও সুপারিশ করেছে তদন্ত সংস্থাটি। করোনা মোকাবিলার বিশেষ অর্থ বরাদ্দ থেকে ব্যয়ের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরম্যান্ট রুলস-২০০৮, ২০১৬ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা নির্দেশনা এবং বাংলাদেশ ট্রেজারি রুলসসহ সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান না মানার বিষয়টিও উঠে এসেছে তদন্তে। এদিকে সরকারের গঠিত এ তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, তদন্তকালে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলো থেকে যথাযথভাবে সহায়তা করা হয়নি। এছাড়া তথ্য প্রদানে অসহযোগিতা ও বিভিন্ন বিলের তথ্যও দিতে গড়িমসি করা হয়েছে।
কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল: করোনাকালে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হোটেল ব্লু বার্ডের প্রস্তাবিত দরের চেয়ে বেশি দরে এবং হোটেলে প্রকৃত
অবস্থানকারীর চেয়ে বেশিসংখ্যক অবস্থানকারী দেখিয়ে ৮০ লাখ ৫০ হাজার টাকা বেশি বিল পরিশোধ করেছে। গত বছরের ১৪ এপ্রিল ব্লু বার্ডের সঙ্গে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের কর্মচারীদের থাকা ও খাওয়া বাবদ মাথাপিছু ৪ হাজার ৫০০ টাকা দৈনিক ভিত্তিতে চুক্তি হয়। কিন্তু এর আগে হাসপাতালটির চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত এক প্রস্তাবে দেখা গেছে, সেখানে জনপ্রতি দৈনিক থাকা ও খাওয়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছিল। সেই হিসেবে এখানে জনপ্রতি দেড় হাজার টাকা বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। একইভাবে এই হোটেলে অবস্থানকারী লোকজনের সংখ্যা বেশি দেখানো হয়েছে। এই হাসপাতালটি আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসেবে
বিধিবহির্ভূতভাবে আরও ২৫ লাখ ২৪ হাজার ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করেছে। এছাড়া কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল থেকে রিজেন্ট ডিসকভারি ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে হোটেল ভাড়া ও খাবার বিল হিসেবে ২ কোটি ২৬ লাখ ৮৬ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করে সরকারি অর্থের ক্ষতি করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উঠে আসে। এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার ধরন ট্রাভেল এজেন্ট হলেও তাদের হোটেলের রুম ভাড়া ও খাবার বাবদ এ বিপুল অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এসব অর্থ ব্যয় করার সময় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ডাক্তার একেএম সরওয়ারুল আলম।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল: কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসা খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ দেখানো হয়েছে। এখানে মোট ৯৫ লাখ ৪৪ হাজার ৯৭৫ টাকার বিল পরিশোধ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তা বরাদ্দ করা অর্থের বাইরের খাত। এছাড়া কুর্মিটোলা ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনিয়মিতভাবে মোট ১ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭৭৫ টাকা খরচ দেখিয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার কাজে নিয়োজিতদের জন্য হোটেল নিউ ইয়র্ক ও হোটেল ওসমানী ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি করে হাসপাতাল র্কর্তৃপক্ষ। এ খাতে হাসপাতাল র্কর্তৃপক্ষের বিল ভাউচার ও চুক্তিপত্রসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ড থেকে দেখা যায়, হোটেল দুটিতে অবস্থান করা প্রকৃত লোকজনের চেয়ে বেশি অবস্থানকারী দেখিয়ে ১৩ লাখ ৪৭ হাজার ৫৫০ টাকা বেশি খরচ দেখানো হয়েছে।
মহানগর জেনারেল হাসপাতাল: স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিডফোর্ড) হাসপাতালের তত্বাবধানে ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে কভিড-১৯ ইউনিট চালু করা হয়। এরপর এ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ময়লা কাপড় ধোলাইর জন্য মোট ২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৫ টাকা খরচের নামে অর্থ ব্যয় করেছে। চলতি বছরের ২৮ জুন মেসার্স রাসেল এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে পুরো অর্থ পরিশোধও করা হয়েছে কাগজেকলমে। যদিও গত ১৫ এপ্রিল জারি করা অফিস আদেশে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী খরচের এ খাতটি কোয়ারেন্টাইন বহির্ভূত। এছাড়া দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রথমদিকে হোটেল দি ক্যাপিটালের সঙ্গে তাদের চিকিৎসকদের থাকার জন্য মুগদা জেনারেল হাসপাতাল রুম প্রতি ২৫০০ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়। একই সময়ে ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল তাদের চিকিৎসকদের থাকা-খাওয়ার জন্য এ হোটেলের সঙ্গে রুমপ্রতি চুক্তিবদ্ধ হয় ৩১০০ টাকায়। বিল-ভাউচার থেকে দেখা যায়, রুমপ্রতি দৈনিক ৬০০ টাকা বেশি পরিশোধ করা হয়েছে সরকারি কোষাগার থেকে। হাসপাতালটির রক্ষণাবেক্ষণের নিজস্ব তহবিল থাকার পরও করোনাকালে দেওয়া বিশেষ বরাদ্দ থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে নানা কেনাকাটা বাবদ ২ লাখ ৪১ হাজার ৯০০ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে কভিড আক্রান্তের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থকর্মীদের খাওয়াদাওয়া বাবদ বিলে। সেখানে ৭ জন ব্যক্তির নামে মোট ৩২ লাখ ৩ হাজার ২৭৫ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এসময় হাসপাতালটিতে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. প্রকাশ চন্দ্র রায়।
মুগদা জেনারেল হাসপাতাল:মুগদা জেনারেল হাসপাতালে কভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এশিয়া হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি হয় জনপ্রতি ২ হাজার ৯৫০ টাকায়। এ হোটেলে মোট ভাড়াযোগ্য কক্ষ ৪৫টি। এরমধ্যে একক বেডের কক্ষ ১৫টি, ডাবল বেডের কক্ষ ২৪টি এবং তিন বেডের কক্ষ ৬টি। কিন্তু পরিশোধ করা বিলে দেখা যায়, কক্ষপ্রতি ভাড়া হিসাব না করে অবস্থান করা লোকের বিল দেখানো হয়েছে। এতে কক্ষের অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এ বিল পরিশোধের সময় ডা. শহিদ মো: সাদিকুল ইসলাম,ডা. শাহ গোলাম নবী,ডা.মো:রওশন আনোয়ার ও ডা.মো: আবুল হাশেম শেখ পরিচালক পদে দায়িত্বে ছিলেন। সূত্র-সমকাল