চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন আবুল কাশেম ওরফে জীবন বেপারী। পুলিশের চরিত্রে তার একাধিক সিনেমা রয়েছে। অভিনয় করতে গিয়ে পুলিশের নানা কলাকৌশল আয়ত্ত করেন। রাস্তায় চলতি পথে ডিবি পুলিশ কীভাবে আসামি ধরে- সবই রপ্ত করেছেন সিনেমা করতে গিয়ে। কিন্তু চলচ্চিত্র-জীবনে সুবিধা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ‘ভুয়া ডিবি’ চক্রে নাম লেখান জীবন বেপারী। মাইক্রো নিয়ে নেমে পড়েন রাস্তায়। এর পর আর তাকে টাকার অভাবে পড়তে হয়নি। ভুয়া ডিবি পরিচয়ে ছিনতাই করে কোটিপতি হয়েছেন ব্যর্থ অভিনয়শিল্পী জীবন বেপারী।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার নামাপাড়ায় জীবন বেপারী আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। সোয়া দুই কাঠা জমির ওপর তৈরি ভবনের প্রতি ফ্লোরে দুটি ইউনিট। এ ছাড়া মুগদা ও নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়ায় তার দুটি বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু জীবন বেপারী আলিশান বাড়িতে বেশিদিন থাকতে পারেন না। কারণ তাকে বারবার যেতে হয় কারাগারে। এখনও তিনি কারাগারেই আছেন।
ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার পরিচয়ে রাস্তায় নামেন মাইক্রোবাস নিয়ে। গায়ে ডিবি লেখা জ্যাকেট, হাতে ওয়াকিটকি, কোমরে পিস্তল- সবই রাখেন তিনি। ব্যাংক থেকে টাকার ব্যাগ নিয়ে কেউ বের হলেই পিছু লাগে ভুয়া ডিবি। সুযোগ বুঝে গাড়ি থেকে নেমেই চক্রের কেউ একজন বলে ওঠে- ‘স্যার, এই সেই অপরাধী।’ এর পরই টার্গেট ব্যক্তিকে দ্রুত গাড়িতে তুলে নিয়ে মুখ বেঁধে ফেলা হয়। হাতে পরিয়ে দেওয়া হয় হাতকড়া। এভাবেই ভুয়া ডিবি পরিচয়ে প্রায় দেড় যুগ ধরে রাজধানী ঢাকায় মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে আসছেন জীবন বেপারী ও তার সহযোগীরা।
একাধিকবার গ্রেপ্তারও হয়েছেন এ চক্রের প্রধান মো. বারেক ও জীবন বেপারী। কিন্তু অপরাধের এ পথ ছাড়েননি তারা। জামিনে বেরিয়ে ফিরেছেন সেই একই ‘পেশায়’। গত ২৮ সেপ্টেম্বর আবারও বারেক, জীবনসহ তিনজন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ওয়ারী বিভাগের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অপরজনের নাম স্বপন আকন্দ। তারা বর্তমানে কারাগারে।
ডিবির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জসীম উদ্দিন বলেন, এই চক্র ভুয়া ডিবি পরিচয়ে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা লুট করে আসছিল। টাকা লুটের ঘটনায় বিভিন্ন থানায় বারেকের বিরুদ্ধে আটটি, জীবনের বিরুদ্ধে সাতটি এবং স্বপনের বিরুদ্ধে নয়টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে আরও মামলা আছে বলে জানা গেছে। সেগুলোর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারের পর ওই তিনজন জানিয়েছেন; প্রতিদিন ৪-৫টি ব্যাংকে তাদের চক্রের একজন করে সদস্য সোর্স হিসেবে ব্যাংকের ভেতরে বা সামনে অবস্থান করে। আর বারেক, জীবনসহ অন্যরা মাইক্রোবাস কিংবা প্রাইভেটকারে ব্যাংকের আশপাশে অবস্থান নেন। ব্যাংক থেকে মোটা দাগে টাকা উত্তোলন করে কেউ বের হলেই ব্যাংকে থাকা সোর্স ফোনে জানায় বারেক বা জীবনকে। দেহের গঠন, পোশাক-পরিচ্ছদ সব তথ্যই ফোনে জানায় ওই সোর্স। প্রয়োজনে তার পিছু নেওয়া হয়। রাস্তায় টার্গেট ব্যক্তিকে ডিবি পরিচয়ে গাড়িতে তুলে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন তারা। পরে নির্জন স্থানে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে চলে যান। প্রতি মাসে তারা ডিবি পরিচয়ে ৫-৭টি ছিনতাই করেন। বারেক ও জীবনের চক্রে জহিরুল ইসলাম ওরফে জহির, মাসুদ, সিরাজ, ইমরানসহ অন্তত ১০ জন সদস্য রয়েছে। নারী সদস্যও আছে এ চক্রে।
বারেকের বাড়ি শরীয়তপুরের সখিপুর থানার মহেশখালী গ্রামে। জীবন বেপারীর গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের টংগীবাড়ী থানার রায়হাল এলাকায়। স্বপনের বাড়ি পটুয়াখালীর উত্তর ভাদুরায়। তবে তাদের প্রত্যেকের বসবাস রাজধানীতে। বারেক ভুয়া ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে রামপুরায় এক গৃহবধূকে বিয়েও করেছিলেন। পরে ওই নারী বারেকের প্রতারণার বিষয়টি জানতে পেরে তাকে তালাক দেন।