স্বাস্থ্যসেবার কেলেঙ্কারির খেসারত!
ডা. আবুল কালাম আজাদ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি)। কারোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে সীমাহীন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনায় দুর্নীতি আর নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে তীব্র সমালোচনায় পড়েন তিনি।
অবশেষে তোপের মুখে মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন আবুল কালাম আজাদ। এরপর তার বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসতে থাকে একের পর এক অভিযোগ। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বুধবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে। সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে দুদক কার্যালয়ে উপস্থিত হন তিনি। তবে এক সময় বিশাল বহর নিয়ে চলাফেরা করতেন আবুল কালাম আজাদ। অথচ গতকাল ব্যাগ হাতে একাই দুদক কার্যালয়ে যেতে দেখা যায় তাকে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা আবুল কালামকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদক পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিম।
দুদক কার্যালয় থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ডা. আবুল কালাম আজাদ। এ সময় তিনি বলেন, ‘সিএমএসডি কর্তৃক কোভিড সংশ্লিষ্ট ক্রয় বিষয়ে অভিযোগ ওঠায় দুদক তদন্ত করছে। সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে আমি কী জানি তা শোনার জন্য দুদকের কর্মকর্তারা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। আমি যা জানি তা বিস্তারিত বলেছি।’
নিজেকে নিষ্ঠাবান, দক্ষ ও সফল দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি একজন কঠোর পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবাদ, সৎ, দক্ষ, সফল ও মেধাবী কর্মকর্তা হিসেবে সারা জীবন কাজ করেছি। আমি একজন অহঙ্কার এবং অহমিকামুক্ত, সরল এবং সজ্জন ব্যক্তি। অপরাধীর শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, ‘কেউ অপরাধ করলে কঠোর শাস্তি হোক তা আমি চাই। এ বিষয়ে তদন্তে আমি সব ধরনের সহযোগিতা করব।’
এদিকে করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ ও চিকিৎসার বিষয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের চুক্তির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আজ বৃহস্পতিবার আবারো মুখোমুখি হতে ডা. আজাদকে দুদক কার্যালয়ে হাজির হতে হবে। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদে ছিলেন ডা. আবুল কালাম আজাদ। সরকারি চাকরির বয়স শেষ হওয়ার পরও তাকে চুক্তিতে নিয়োগ দিয়ে ওই পদের দায়িত্ব দিয়েছিল সরকার। সে অনুযায়ী তার মেয়াদ শেষ হওয়ার সময়কাল ছিল আগামী বছরের এপ্রিলে। কিন্তু গত মার্চে দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের একের পর এক কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ হতে থাকলে বিপাকে পড়েন তিনি।
মার্চের শেষ ভাগে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে যেসব মাস্ক পাঠানো হয়, তার প্যাকেটে ‘এন-৯৫’ লেখা থাকলেও ভেতরে ছিল সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক। সে সময় সমালোচনার মধ্যে আরো অনেকের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের নামও উঠে আসে। এরপর করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিয়ে জেকেজি হেলথ কেয়ার ও রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা ও জালিয়াতির খবর ফাঁস হলে ডা. আজাদ তোপের মুখে পড়েন। বিভিন্নমুখী সমালোচনার মধ্যেই গত ২১ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র দেন তিনি।
এদিকে দুদক বলছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরস্পর যোগসাজশের মাধ্যমে ‘অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য ‘নিম্নমানের’ মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনে বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এমন অভিযোগ এসেছে কমিশনের হাতে। এসব অভিযোগের অনুসন্ধানে গত ১৫ জুন দুদক কর্মকর্তা জয়নুল আবেদীন শিবলীকে প্রধান করে চার সদস্যের এই অনুসন্ধান টিম গঠন করে কমিশন। টিমের প্রধান শিবলী গত ৬ আগস্ট আবুল কালাম আজাদকে দুদকে তলব করে চিঠি পাঠান।
গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা সোয়া ৩টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের পর অধ্যাপক আজাদ বেরিয়ে এলে তাকে ঘিরে ধরেন সাংবাদিকরা। তিনি তখন সঙ্গে থাকা কাগজ থেকে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের উত্তর না তিনি এড়িয়ে গেছেন। তবে পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আজাদ বলেন, ‘আমি লক্ষ্য করছিলাম, আমাকে নিয়ে অপপ্রচারের অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। পদ আঁকড়ে রাখা আমার কাছে সম্মানের বিষয় নয়। তাই বিবেকতাড়িত হয়ে গত ২১ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদ থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করি।’
দুদকে আসার কারণ ব্যাখ্যা করলেও জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে কোনো তথ্য আজাদ তার লিখিত বক্তব্যে দেননি। তবে তিনি বলেন, সিএমএসডি কর্তৃক কোভিড সংশ্লিষ্ট ক্রয় সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে। সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে এ বিষয়ে আমি কী জানি, তা শোনার জন্য তদন্ত কর্মকর্তারা আজ আমাকে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমি যা জানি তা তাদের বিস্তারিত বলেছি। তদন্তাধীন বিষয় সম্পর্কে এ মুহূর্তে আমার পক্ষে এর চেয়ে বেশি কিছু আপনাদের বলা সম্ভব নয়।
এরপর নানা বিশ্লেষণে নিজেকে উপস্থাপন করে অধ্যাপক আজাদ বলেন, ‘জনসাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সকল ক্ষেত্রেই আমার পর্যাপ্ত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং কর্মদক্ষতা আছে। কোভিডের মতো মহাদুর্যোগ যাতে লাখ লাখ মানুষের জীবনহানি না ঘটে, সেজন্য আমার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বিবেকবোধ ও সদিচ্ছা থেকে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে কাজ করে এসেছি। কোভিড থেকে নিজেকেও বাঁচাতে পারিনি, মৃত্যুর দুয়ার থেকে পরম করুণাময়ের অনুগ্রহে এবং চিকিৎসকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সুস্থ হয়েছি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরদিনই কাজে যোগ দিয়েছি। কারণ কোভিড এমন এক মহাদুর্যোগ, যে বিশ্রামের কথা ভাবতে পারিনি।
চিকিৎসক, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ীসহ সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. আজাদ বলেন, ‘সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, কেউ অপরাধ করলে তার কঠোর শাস্তি হোক এটা আমি চাই, এ বিষয়ে তদন্তে আমি প্রয়োজনীয় সকল সহযোগিতা প্রদান করব।’
অন্যদিকে গতকাল বুধবার রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক (ওএসডি) ডা. মো. আমিনুল হাসান, উপ-পরিচালক মো. ইউনুস আলী এবং গবেষণা কর্মকর্তা ডা. মো. দিদারুল ইসলামকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।