করোনাভাইরাস মোকাবেলার কার্যক্রম ঘিরে নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মুখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও পরিচালক পর্যায়ের কয়েকজনের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ ছিল গত মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত, যাঁদের অপসারণ বা পদত্যাগ করার দাবিও উঠেছিল জোরালোভাবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে শুদ্ধি অভিযানের আওতায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব, কয়েকজন অতিরিক্ত ও যুগ্ম সচিবকে বদলি করা হয়েছে অন্য মন্ত্রণালয়ে; পদত্যাগ করতে হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে, অপসারণ করা হয়েছে একাধিক পরিচালককে, কাউকে কাউকে বদলি করা হয়েছে। দুদকে হাজিরা দিতে হয়েছে সাবেক স্বাস্থ্যসেবাসচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, একাধিক পরিচালকসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তাকে। রীতিমতো ঝোড়োবেগে এত সব পরিবর্তন হলেও আঁচড় লাগেনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর গায়ে; তিনি বহাল স্বপদে। অন্য পদগুলোতে নতুন নতুন লোক বসানো হলেও ঝড়ের ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছে না স্বাস্থ্য খাত; বরং পদে পদে ভর করছে স্থবিরতা। থমকে আছে করোনা মোকাবেলাসহ বেশির ভাগ কাজ।
বর্তমান পরিস্থিতির জন্য স্বাস্থ্য খাতের বিশিষ্টজনরা আগের মতোই দুষছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেককেই। তাঁদের মতে, মন্ত্রী যেমন এত দিন মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি বন্ধে ব্যর্থ ছিলেন, এখনো তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না। একদিকে যেমন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে পারছেন না, তেমনি নিজের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের অন্যদের সমন্বয়ের ঘাটতিও দূর করতে পারছেন না। অনেকেই মনে করছে, স্বাস্থ্য খাতে এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীরই নিয়ন্ত্রণ নেই, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এই খাতে।
জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুব বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের নেতৃত্ব দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আগের যে পরিস্থিতির কারণে এ খাতের ওপরে ঝড় বয়ে গেছে, সেটার দায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী এড়াতে পারেন না। তিনি হয়তো কোনো কারণে ঝড়ের কবল থেকে টিকে গেছেন, কিন্তু এখনো তো যা চলছে, সেটাও সামাল দিতে পারছেন না। কোনো কাজেই গতি দেখছি না। মহামারির এমন জরুরি পরিস্থিতির মধ্যে প্রতিমুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ।
সচিব, মহাপরিচালকসহ যাঁদের চেয়ারে অদলবদল হয়েছে তাঁদের থিতু হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই মহামারির ভেতর সেই সময় তো তাঁদের পাওয়ার কথা নয়। বরং মন্ত্রীর বিচক্ষণ নির্দেশনা দিয়ে তাঁদের চালাতে পারার ওপরই এখন সব কিছু নির্ভর করছে। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থতা দেখছি।’
বিএমএর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘কত দিন পার হয়ে গেল, চিকিৎসকদের আবাসন নিয়ে জটিলতা কাটানোর জন্য আমরা বলে আসছি, কিন্তু এখনো এর কোনো সুরাহা করতে পারছেন না মন্ত্রী বা সচিব। সামনে এসংক্রান্ত পরিস্থিতি খারাপ হলে তখন তো বিপদ আরো বাড়বে। সব জায়গায়ই স্থবিরতা চলছে, এটা ভালো লক্ষণ নয়। স্বাস্থ্য খাতের ওপরে এখন মন্ত্রীর নিজেরও নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না।’
জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি স্থবিরতা বিরাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জুড়ে। কোনো কাজেই এখনো গতি আসেনি, বরং উল্টো আটকে যাচ্ছে আগের গতিশীল কাজগুলোও। এ ছাড়া মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এখনো কাটেনি, ক্ষেত্রবিশেষে তা আগের চেয়ে আরো বেড়েছে। অনেক সিদ্ধান্তই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়ার ফলে এসব বিষয়ে অন্ধকারে থেকে যাচ্ছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি অধিদপ্তরের আওতায় নতুন কয়েকটি পদে নিয়োগ নিয়েও ভেতরে ভেতরে রয়েছে চাপ ও অসন্তোষ। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঘিরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বাইরেও গোটা চিকিৎসকমহলেই বিরাজ করছে ক্ষোভ, যা নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই অসহায় অবস্থায় পড়েছে অধিদপ্তর। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক পর্যায়ের সঙ্গে মন্ত্রীরও মতের ভিন্নতা প্রকাশ পাচ্ছে মাঝেমধ্যেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, করোনা হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকারী চিকিৎসক, নার্স ও অন্য কর্মীদের আবাসন সুবিধা বাতিলসংক্রান্ত যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় গত মাসের শেষ সপ্তাহে, সে ব্যাপারে মন্ত্রী নিজেও রাজি ছিলেন না। বরং তাঁকে পাশ কাটিয়েই ওই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় সচিবের নির্দেশনায়। একইভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সরকার গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি কিংবা চিকিৎসক সংগঠনগুলোরও এ ক্ষেত্রে কোনো মতামত নেওয়া হয়নি, যার মাসুল দিতে হচ্ছে সব হাসপাতালকে। অনেকটাই আবার চিকিৎসা বিমুখ হয়ে পড়ছেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালের পরিচালকরা পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেকটা হিমশিম খাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, স্থবিরতা এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে জরুরি অনেক কাজও করা যাচ্ছে না। জরুরি গুরুত্বপূর্ণ কেনাকাটায় অধিপ্তরের যে কমিটি রয়েছে সেই একাধিক কমিটির সভাপতি হচ্ছেন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকরা আর সদস্যসচিব হচ্ছেন অধিদপ্তরের আওতাধীন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতির মুখে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক পদে মন্ত্রণালয় থেকে একজন অতিরিক্ত সচিবকে বসানোর ফলে হিতে বিপরীত হচ্ছে। অতিরিক্ত মহাপরিচালকরা কোনো মিটিং ডাকলে সেখানে ওই পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আসেন না। এ পর্যন্ত কয়েকটি মিটিং পণ্ড হয়েছে এ কারণে। ফলে প্রয়োজনীয় অনেক সিদ্ধান্ত আটকে গেছে। অন্যদিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিদপ্তরকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত একটি কমিটির মাধ্যমে কেনাকাটার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যে ব্যাপারে অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল পদের কর্মকর্তারা জানেন না কিছুই।
কোন হাসপাতালে কভিড চিকিৎসা থাকবে বা বাদ যাবে, এসব বিষয়েও অধিদপ্তর অন্ধকারে আছে। কোনো কোনো হাসপাতাল এরই মধ্যে করোনা রোগী ভর্তি বন্ধ করে দিয়েছে, যদিও অধিদপ্তর থেকে এখনো আদেশ দেওয়া হয়নি। ওই হাসপাতালগুলো থেকে বলা হচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই তারা রোগী ভর্তি বন্ধ করেছে।
অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ নিয়ে পাঁচ মাস ধরে চলা বুলেটিন বন্ধ করে দেওয়া নিয়েও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে অধিদপ্তরকে। এটি আবার চালু করা হবে কি না তা জানা নেই অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। করোনা টেস্ট, অ্যান্টিবডি বা অ্যান্টিজেন টেস্টের কিট সংগ্রহ নিয়েও জটিলতা কাটেনি। সরবরাহকারীদের বকেয়া বিল পরিশোধে খুব একটা অগ্রগতি নেই, আবার মন্ত্রণালয় থেকে চিকিৎসকদের হোটেলে থাকা বন্ধ করা হলেও হোটেলের বকেয়া বিলও আটকে আছে। ঢাকার বাইরে হাসপাতালগুলোতে করোনা চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সরবরাহের অগ্রগতি সম্পর্কেও জানাতে পারছে না অধিদপ্তর।
এসব বিষয়ে চেষ্টা করেও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তাঁরা রিসিভ করেননি। সূত্র: কালের কণ্ঠ