1. [email protected] : admi2017 :
  2. [email protected] : Daily Khabor : Daily Khabor
  3. [email protected] : rubel :
  4. [email protected] : shaker :
  5. [email protected] : shamim :
সোমবার, ২৯ মে ২০২৩, ০৬:৫৪ অপরাহ্ন

হত্যাযজ্ঞের শুরু থেকে শেষ

ডেইলি খবর নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট সময় শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০
  • ৩১০ বার পড়া হয়েছে

মাসরুর আরেফিন: এ মৃত্যুলীলা পূর্বঘোষিত। ১৫ই আগস্ট ভোরে ধানমণ্ডির দুই বাসায় এবং ২৭ নম্বর মিন্টো রোডের এক বাসায় যা যা ঘটে, তা সবাইকে প্রকাশ্যে জানিয়েই ঘটা শুরু হয় ১৪ আগস্ট বিকেল থেকে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর শাহরিয়ার রশিদ খানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে খন্দকার মোশতাকের পুরান ঢাকার বাসার দিকে রওনা হয় মেজর রশিদ ও মেজর নূর চৌধুরী। মোশতাক অনেক চিন্তিত। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দুপুর থেকে পানি ছাড়া আর কিছু খায়নি সে। মেজর রশিদ নিজ হাতে বসার ঘরের দরজা আটকে দিয়ে তাকে বলল, ‘ডোন্ট বি সো নার্ভাস, স্যার। ইউ হ্যাভ আ লট টু ডু ফ্রম টুমরো মর্নিং।’ হঠাৎ খেপে গেল মোশতাক, রেগে উঠে দাঁড়িয়ে রশিদকে বকা দিল, ‘বিয়িং মাই রিলেটিভ, ইউ শুড হ্যাভ নোন মি বেটার। আই অ্যাম নট নার্ভাস, আই অ্যাম জাস্ট অ্যাংকশাস অ্যাবাউট হাউ মাচ ইফিশিয়েন্টলি ইউ কিডস আর ক্যাপাবল অব হ্যান্ডলিং অল দিস।’

সাতমসজিদ রোড ধরে উত্তর দিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোড, তারপর আবার মিরপুর রোডে উঠে ৩২ নম্বর রোডের মাথার দিকে যাই। তখন ভেসে আসছে অজস্র গুলির শব্দ। বোঝা যায়, তারা এইমাত্র শেখ মনি ও তাঁর স্ত্রীকে মেরে ফেলেছে। ৩২ নম্বর রোডের মুখে দুটো ট্যাংক, চলছে। বিউগলের শব্দ বাজে কানে। দুটো দৃশ্য একসঙ্গে এ রকম—সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার একটা জিপ থেকে নামছে, তার চেহারা কুমিরের মতো, ভরা পেট, ক্লান্ত কুমির; এবং সাত-আটজন হাবিলদার একসঙ্গে বিউগল বাজাচ্ছে, দেশের পতাকা উত্তোলন করা হচ্ছে রাষ্ট্রপতির বাসায়।

দোতলার বড় বেডরুমের ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলেন বেগম মুজিব, ছোট ছেলে রাসেল ও বঙ্গবন্ধু নিজে। এ বাড়ির সবাই এখন এই ঘরে, স্রেফ বঙ্গবন্ধু নেই। তিনি আছেন রিসেপশন রুমে, কথা বলছেন তাঁর পিএ মুহিতুল ইসলামের সঙ্গে, পরনে একটা চেক লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি। তিনি বারবার বলছেন, ‘এত গুলির শব্দ কেন?

এত গুলির শব্দ কেন?’ বেগম মুজিব তখন ছোটাছুটি করছেন দোতলায়। বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বললেন, ‘কামাল নিচে যা, বাসা কারা অ্যাটাক করেছে, দ্যাখ। নুরুল ইসলাম কোথায়? কামাল, হাউস গার্ডরা কোথায়? জামাল, জামাল দৌড়ে যা, সেন্ট্রি পোস্টগুলো দ্যাখ।’ সিঁড়ি দিয়ে কামাল নিচে নামলেন। বাইরে তখন প্রচণ্ড গুলির শব্দ। মেশিনগানের ফায়ারিং সব কাঁপিয়ে দিয়েছে। জামালকে দেখা গেল নড়ছেন না, তিনি বউয়ের হাত ধরে বসে আছেন মায়ের রুমে। তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেন, ‘যাও।’ রোজী জামাল সামান্য ‘যাও’ কথাটা বললেন অতি জোরে, আতঙ্ক থেকে। বেগম মুজিব কোত্থেকে ছুটে এই ঘরে এলেন, উঁকি দিয়ে ভেতরে তাকালেন, বললেন, ‘সেরনিয়াবাতের বাসায় সবাইকে মেরে ফেলেছে রে। শেখ মনির বাসায় মনি ও আরজু দুজনকেই মেরে ফেলেছে। কামাল, কামাল। নুরুল ইসলাম কই? নুরুল ইসলাম।’

শেখ কামাল নিচে নেমে এলেন। ঠিক পেছনে পিএ মুহিতুল সাহেব। হঠাৎ গেট ধাক্কা দিয়ে এদিকে এগোতে থাকল কালো ও খাকি পোশাকের দশজনের মতো একটা দল। তারা কাছাকাছি পৌঁছে গেল একমুহূর্তে, গাড়িবারান্দা ও গেটের দূরত্ব অতখানিই কম। একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘হ্যান্ডস আপ’, ‘হ্যান্ডস আপ’। বিভ্রান্ত কামাল ও পুলিশের তিনজন—নুরুল ইসলাম, সিদ্দিকুর রহমান, খোরশেদ আলী—একসঙ্গে হাত উঁচু করলেন। শেখ কামালের চোখে-মুখে বিস্ময়। তিনি হাত উঁচুতে তোলা অবস্থায়ই বললেন, ‘আমি শেখ কামাল। শেখ মুজিবের ছেলে কামাল।’ আরো দুবার দলটা বলে উঠল, ‘হ্যান্ডস আপ’, ‘হ্যান্ডস আপ’।

ক্যাপ্টেন হুদা শেখ কামালকে গুলি করল তাঁর পায়ে। দুটো গুলি। শেখ কামাল পায়ে গুলি নিয়ে লাফ দিয়ে পড়ে গেলেন মুহিতুল ইসলামের ঠিক পাশে। এমনভাবে পড়লেন যে উনার ধাক্কায় মুহিতুলও নিচে পড়ে গেলেন। কামাল পড়তে পড়তে বলছেন, ‘হো-য়া-ট?’ ক্যাপ্টেন হুদা এবার আবার গুলি করল তাঁকে, বুকে ও তলপেটে, শর্ট ব্রাশফায়ার।

বঙ্গবন্ধু তখন বেডরুমে। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে ফোনে বলছেন, ‘সফিউল্লাহ, আমার বাসা তোমার ফোর্স অ্যাটাক করছে। ওরা কামালরে মেরে ফেলছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ ফোন রেখে তিনি ফোন করলেন কর্নেল জামিলকে। শোনা গেল বিভ্রান্ত এক গলা, ‘জামিল, জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোক আমার বাসা অ্যাটাক করেছে।’

হঠাৎ দরজার ওপরে ধুমধাম শব্দ, অনেক শব্দ। বঙ্গবন্ধু উঠে গেলেন, দরজা খুললেন এবং প্রথম মুহূর্তেই রাসেল এক ঝটকায় সবার পায়ের ফাঁক গলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

হুদা সবার সামনে, ল্যান্সারের মহিউদ্দিন তার পাশে, পেছনে নূর। তাদের পেছনে জনাদশেক ল্যান্সার, কালো পোশাক পরা জাগুয়ার বাহিনী। হুদার দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধু চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘তোরা কী চাস? তোরা কী করতে চাস?’

আর্মিরা তাঁকে তাঁরই বেডরুমের সামনে ঘিরে ফেলেছে।

বঙ্গবন্ধু প্রচণ্ড রেগে গেলেন। তাঁর সব ভয় ওই রাগের সঙ্গেই অদৃশ্য হয়ে গেল। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠলেন যেন তিনি। হুদাকে বললেন, ‘তুই আমারে মারতে চাস? কামাল কই? তোরা কামালরে কী করছিস?’ হুদা পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল, তার বাম হাত তখন মহিউদ্দিনের ঘামে ভেজা পিঠের ওপর, তার নিজের কপাল থেকে তখন ঘাম বেয়ে পড়ছে, ঢুকে যাচ্ছে সোজা তার চোখের ভেতরে। সে বলল, ‘কামাল তার জায়গাতেই আছে। আপনি আমাদের তুই তুই করে বলবেন না। আপনি বন্দি। আপনি চলেন।’ এবার বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে এক ধাপ নেমে ডান হাত তুলে ধাক্কা দিলেন হুদার বুকে, খুব জোরে না, খুব আস্তেও না। হুদা একমুহূর্তের জন্য পাশে পড়ল মহিউদ্দিনের গায়ের ওপর। বঙ্গবন্ধু গর্জন করে উঠলেন সিঁড়িঘর কাঁপিয়ে, ‘কী? তোদের এত সাহস? পাকিস্তান আর্মি আমারে মারতে পারে নাই। আমি বাঙালি জাতিরে ভালোবাসি। বাঙালি আমারে ভালোবাসে। আমাকে কেউ মারতে পারে না। তোরা আমারে মারতে পারিস না। তোরা এই সব করিস না। তোরা ভুল পথে আছিস, তোদেরে কেউ ভুল বোঝাইছে। তোরা ভদ্রলোকের বাসায় বেডরুমে ঢুকে গেছিস ভোররাতে? তোরা আমাদের আর্মি, তোরা দেশ রক্ষার হাতিয়ার।’ এর পরের কথাগুলো স্পষ্ট বোঝাও যাচ্ছে না, চিৎকার বেশি—কথার মধ্যে মধ্যে চিৎকার না, চিৎকারের মধ্যে কথা। তিনি চিৎকার ছাড়ছেন, সিঁড়ির আরো কেউ কেউ চিৎকার দিচ্ছে, মাতাল রিসালদার মোসলেম তুমুল চিৎকার করে বলছে ‘থামেন, থামেন, অনেক শুনছি।’

একনাগাড়ে বলা কথাগুলো থামালে হুদা বলল, ‘এসব নাটকীয় কথাবার্তা রাখেন। আপনি চলেন আমার সঙ্গে। আপনি বন্দি।’ এতগুলো কথা বলে বঙ্গবন্ধুর যেন শক্তি শেষ। তিনি এবার শান্ত ও ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘এইভাবে নিয়ে যেতে চাস? আমারে পাইপের তামাক নিতে দে।’ বলেই তিনি উল্টো ঘুরলেন। হুদা তাঁর পেছন পেছন যাচ্ছে। মহিউদ্দিনও সঙ্গে যাচ্ছে। নূর, মোসলেম, সারওয়ার সিঁড়ির মাঝখানের ল্যান্ডিংয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে। স্থির। নূর শুধু চেঁচিয়ে বলল, ‘কোনো ফোন যেন না করতে পারে।’

বঙ্গবন্ধু এখন তাঁর বেডরুমে। হুদা হাতে নিল তাঁর এরিনমোর তামাকের কৌটা ও পাশে রাখা দেয়াশলাই বাক্স। বেডরুমে মাত্র তিনজন। বঙ্গবন্ধু, হুদা ও মহিউদ্দিন।

তাঁরা তিনজন কামরা থেকে বের হলেন। বঙ্গবন্ধু এর মধ্যে একজনকে ধমকে উঠলেন, ‘বেয়াদবি করছিস কেন? আমি তোদের জাতির পিতা।’

হুদা ঝট করে বঙ্গবন্ধুকে টপকে নিচে নেমে গেল, নূরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বঙ্গবন্ধু কেমন সচকিত হয়ে উঠলেন।

নূর চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘স্টপ’।

তারপর আবার, ‘স্টপ। দিজ… হ্যাজ নো রাইট টু লিভ। স্টেপ অ্যাসাইড।’

বঙ্গবন্ধুর একেবারে পেছনে দাঁড়ানো মেজর মহিউদ্দিন এবং ওই তিন সৈনিক মুহূর্তের মধ্যে সিঁড়িবারান্দার তিনতলায় ওঠার দিকটাতে সরে গেল।

নূর চিৎকার করছে ‘স্টপ দেয়ার, স্টপ।’ নূর কনুই দিয়ে গুঁতা দিল হুদাকে। নূর ও হুদার স্টেনগান বঙ্গবন্ধুর বুকের সোজা উঠল।

নূর বলল, ‘ফ্রিজ।’

তার পরই গুলি। ব্রাশফায়ার। মোসলেম ও সারওয়ারও ফায়ার করল। তবে বঙ্গবন্ধুর দিকে নয়। অন্যদিকে, কোন দিকে তা তারাও জানে না, একঝাঁক গুলি। তাঁর তলপেট ও বুক বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। পাশে পড়ে আছে চশমা, চশমার একটা কাচ ভেঙে গেছে। হাতের পাইপ সিঁড়িতে স্থান নিয়েছে। ডান হাতের তর্জনীতে একটা বুলেট লেগেছে, আঙুলটা কোনো রকমে ঝুলে আছে হাতের সঙ্গে। এবার শুরু হলো তাঁর পাঞ্জাবির রক্তে ভিজে ওঠা। প্রথমে ধীরে, তারপর বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো।

বেগম মুজিব ও পরিবারের অন্যরা সবাই তখন বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে একসঙ্গে। বেগম মুজিব, শেখ জামাল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, শেখ নাসের, শেখ রাসেল। বাড়ির কাজের ছেলে রমা সেখানে ঢুকে দিল সেই সংবাদটা। গলার আওয়াজ চেপে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল, ‘সাবেরে আর্মিরা মাইরা ফেলছে।’

বেডরুমের দরজা খোলার জন্য দরজা ধাম ধাম পেটাতে লাগল পাশা ও চার পাঁচজন সৈনিক। ওদিকে মোসলেম ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে তার স্টেনগান হাতে তুলে নিচ্ছে। হঠাৎ দরজা বরাবর ব্রাশফায়ার করল পাশা। তারপর নীরবতা। ঘরের ভেতরে বেগম মুজিব উঠে দাঁড়ালেন এই কথা বলতে বলতে ‘মরলে সবাই একসঙ্গেই মরব।’ বেগম মুজিব দরজা খুললে আর্মিরা শেখ নাসের, শেখ রাসেল, বেগম মুজিব ও রমাকে নিয়ে নিচের তলার দিকে রওনা দিল।

বেগম মুজিব দেখলেন সিঁড়িতে পড়ে আছে তাঁর স্বামীর লাশ, দেখলেন তাঁর মৃত হয়ে যাওয়া স্বামীর পিঠে একটা গর্ত এবং তাঁর পাঞ্জাবি রক্তে ভিজে লেপ্টে রয়েছে শরীরের সঙ্গে। তিনি লাশ দেখে তুমুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন। দশ সেকেন্ড তীব্র কান্নার পর থামলেন তিনি। দৃঢ় গলায় বলে উঠলেন, ‘আমি যাব না। আমাকে এখানেই মেরে ফেল। আমি কোথাও যাব না।’

তাঁর কণ্ঠে এতখানি সাহস, জেদ ও দৃঢ়তা ছিল যে, পাশা থেমে দাঁড়াল। এক সেকেন্ড ভাবল। তারপর বলল, ‘মোসলেম, উনাকে বেডরুমে নিয়ে যাও।’ মোসলেম বেগম মুজিবের হাত ধরল, বলল, ‘চলেন।’ বেগম মুজিব প্রচণ্ড ঝটকায় মোসলেমের হাত ছাড়িয়ে নিলেন। মুখে বললেন, ‘হাত ছাড় তুই।’ মোসলেম এক সেকেন্ডের জন্য ভয় ও অপমানে সাদা হয়ে গেল। বেগম মুজিবের ওই হাত ছেড়ে তার স্টেনগান দুই হাতে নিয়েছে এবার।

এবার? মোসলেম ও এক সেনা বেগম মুজিবকে ধাক্কা মেরে রুমের ভেতরে ঢোকাতে চাইল। বেগম মুজিব গেলেন না তবু। তিনি পাথরের মতো দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তিনজন সেনা এবার এদের টপকে ঘরের ভেতরে ঢুকল। তারা তিনজন একসঙ্গে জড়ো করল সুলতানা কামাল, রোজী জামাল ও শেখ জামালকে বেডরুম ও সংলগ্ন বাথরুমের মাঝখানে। সুলতানা ও রোজী কেবলই বলছেন, ‘না, না, না।’ কিন্তু ততক্ষণে পাশা ও মোসলেম ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলেছে, তাদের স্টেনগানের ব্যারেল বৃত্তাকারে ঘুরছে এই তিনজনের ওপর। এঁরা তিনজন নিচে পড়তেই বন্ধ হলো গুলি। মোসলেম ও পাশা গুলি করার দমকে কাঁপছে, খেয়ালও করেনি এই তিন মানুষের শরীরের কোথায় কোথায় গুলি করে ফেলেছে তারা।

সুলতানা কামালের বুক ও তলপেট গুলিতে ঝাঁঝরা হলো। গুলি লেগেছে তাঁর ডান গালেও। এদিকে একটা চিৎকার বহমান রয়েছে তো রয়েছেই, সেটা আকারে ও আয়তনে বেড়েই চলেছে, শব্দের জোরের বিচারেও উঁচুতে উঠছে তো উঠছেই। বেগম মুজিবের দীর্ঘ এক মিনিটের চিৎকার ছিল ওটা, আর ওই চিৎকারের মধ্যেই—ততক্ষণে তিনি জেনে গেছেন তাঁর মেজো ছেলে শেষ, তাঁর দুই ছেলের বউয়েরাও শেষ—বেগম মুজিবের শরীর তাক করে গর্জে উঠল সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার ও ল্যান্সারের চার-পাঁচজনের হাতের অস্ত্র, তাতে শেষ মুহূর্তে বিনা কারণে যোগ দিল আজিজ পাশার স্টেনগানটাও, অযথা। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পড়ে গেলেন মূল বেডরুমের সামনে, দেউড়িতে, খাবার টেবিলটার পাশে।

আর্মির লোকেরা এবার শেখ নাসেরকে ধরে বসল। একজন সেনা উঁচুগলায় মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শেখ নাসের, শেখ নাসের।’

পাশা একগাদা সৈন্যকে আদেশ দিল, ‘শেখ নাসের, শেখ রাসেল ও এই ছেলেটাকে (রমাকে) নিচে নিয়ে যাও, মামলা খালাস কর।’

রাসেল মায়ের কাছে যাবে বলে কান্নাকাটি করছে। সবাইকে শুইয়ে রাখা হয়েছে লনসংলগ্ন প্যাসেজের সিমেন্টের ওপর।

শেখ নাসেরকে লাইন থেকে আলাদা করে ঘরের দেউড়িতে আনা হলো।

কে যেন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম?’

‘শেখ নাসের।’

‘হাতে কি গুলি লেগেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ব্যথা করছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘মরে গেলে ব্যথা থাকবে না, হা-হা।’ আর্মির লোকটা হাসছে।

শেখ রাসেল লাইনে দাঁড়ানো মুহিতুল ইসলামের পাশে। সে মুহিতুলকে অনবরত বলে চলেছে, ‘কাকা, কাকা, আমাকে মারবে না তো? মার কী হইছে কাকা?’ রাসেল মুহিতুলকে এই একই কথা বলতে বলতে জড়িয়ে ধরে আছে। একজন আর্মি তখন রাসেলকে মুহিতুলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গেল গেটের ডান পাশে যে পুলিশ বাংকার আছে সেখানে। বাংকারটার ভেতরে তারা আটকে রাখল ছেলেটাকে। একজন সেন্ট্রি গার্ড দিতে লাগল বাংকার। আমি শুনলাম রাসেল কাঁদছে ও বলছে, ‘আমি মার কাছে যাব।’ এ সময় বাড়ির সামনে একটা ট্যাংক এসে থামল, পেছনে একটা জিপ। আমি দূরে ইংরেজিতে বলা কিছু কথা শুনলাম। কথা না, শব্দ। যেমন, হারিড, ইমপসিবল, ব্লাফ, ডিসঅ্যাপয়েন্ট, ডেসপাচ, ব্লাডি।

আমি শুনতে পেলাম শেখ নাসের আর্মির সেই লোকটাকে বলছেন, ‘স্যার, আমি তো রাজনীতি করি না। কোনোরকমে ব্যবসা করে খাই।’

আমি দেখলাম মেজর আজিজ পাশা গেটের দিকে যাচ্ছে। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কাকে যেন ওয়্যারলেসে বলছে, ‘শেখ নাসের ডাউন। রাইট নাউ। ডাউন অ্যান্ড আউট। ডাউন অ্যান্ড আউট।’ কথাটুকু বলে সে আবার গেটের সামনে। রাসেল তখনও ওই বাংকারের মধ্যে বন্দি অবস্থায়, মায়ের কাছে যাবে বলে কেঁদেই যাচ্ছে তখনও। পাশা এবার ওয়্যারলেসে শেখ রাসেলের ব্যাপারে কার কাছে কী যেন অনুমতি চাইল। ‘হোয়াট ডু উই ডু উইথ দ্যাট ইলেভেন ইয়ারস ওল্ড বয়? হোয়াট? হোয়াট। ওকে। নোটেড।’

সজল রাসেলকে হাত ধরে দোতলায় নিয়ে যাচ্ছে, মুহিতুল ইসলাম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন, তার মুখ থেকে বেরোচ্ছে ‘ও আল্লা, ও আল্লা’ ডাক; ডাক নয়, গোঙানি। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ পার হওয়ার সময় শেখ রাসেল সেদিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে শুধু বলল, ‘আব্বু, আব্বু, বাঁচাও, আব্বু, বাঁচাও।’

স্টেনগানের গুলিবৃষ্টিতে রাসেল ঝাঁঝরা হয়ে গেল। তার পরনের হাফপ্যান্ট ততক্ষণে পুরো লাল, জানালার ফাঁক গলে এক আলোর রেখা এসে পড়েছে তার মুখে।

লেখক : গবেষক-ঔপন্যাসিক। ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন। গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতেই দাঁড় করিয়েছেন সেদিনের মৃত্যুলীলার এই চিত্র।

বিজ্ঞাপন

এ জাতীয় আরো খবর