কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ১০ মামলা অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এ অনুমোদন দেওয়া হয় বলে দুদক সচিব ড. মু আনোয়ার হোসেন হাওলাদার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
মামলার অনুমোদনের পাশাপাশি পি কে হালদারের সহযোগী ৩৩ জনের সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য নোটিশ জারির অনুমোদনও দিয়েছে দুদক। একই সঙ্গে এদিন পি কে হালদারের ৪৪ সহযোগীর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
আনোয়ার হোসেন হাওলাদার জানান, শিগগিরই অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে মামলাগুলো দায়ের করবেন। অনুমোদন করা প্রতিটি মামলাতেই রিলায়েন্স লিজিং ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদারকে আসামি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে ভুয়া কম্পানি ও বিভিন্ন ব্যক্তির হিসাবে ওই অর্থ স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অপরাধ করেছেন অভিযুক্তরা।
দুদক সচিব জানান, পি কে হালদার ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, এমডি মো. রাশেদুল হক, ভারপ্রাপ্ত এমডি মো. আবেদ হোসেন এবং প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড সদস্যসহ পি কে হালদারের অন্য সহযোগীদের আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দ্রিনান অ্যাপারেলসের চেয়ারম্যান কাজী মমরেজ মাহমুদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবু রাজীব মারুফ, ইমেক্সোর প্রপ্রাইটর ইমাম হোসেন, লিপরো ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উত্তম কুমার মিস্ত্রি, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের দুই পরিচালক সুকুমার সাহা ও তাঁর মেয়ে অনিন্দিতা সাহা, আর্থস্কোপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান প্রশান্ত দেউরী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরা দেউরী, ওকায়ামা লিমিটেডের চেয়ারম্যান সুব্রত দাস, আরবি এন্টারপ্রাইজের মালিক রতন কুমার বিশ্বাস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেসের পরিচালক পাপিয়া ব্যানার্জী ও তাঁর স্বামী পরিচালক বাসুদেব ব্যানার্জীকে আসামি করা হয়েছে।
এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেসের পরিচালক এম নুরুল আলম, পরিচালক নওশের-উল ইসলাম, পরিচালক নাসিম আনোয়ার, পরিচালক নুরুজ্জামান, পরিচালক আবুল হাসেম, জহিরুল আলম ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেনসহ অন্যদের আসামি করা হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, অধিকতর অনুসন্ধান করতে গিয়ে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে এসেছে। সূত্র মতে, পি কে হালদারের মাথার ওপর ছায়ার মতো ছিলেন ঘনিষ্ঠ রুনাই আহমেদ। বিশেষ করে রুনাইকে দিয়ে সরকারের উচ্চ মহল ম্যানেজ করতেন পি কে হালদার। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পি কে হালদার তাঁর সহযোগীদের জাল এনআইডি দিয়ে রুনাই, রাফসান, সোহাগ, আব্দুল আলিমদের সহায়তায় রিলায়েন্স ফিন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং এফএএস লিজিং থেকে প্রায় দুই ডজন ভুয়া কম্পানির নামে ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পাঁচ হাজার কোটি টাকা তুলে নেন এবং বিদেশে পাচার করেন। এ ক্ষেত্রে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মাত্র দুটি ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে।
দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে চার সদস্যের অনুসন্ধান টিমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের এমডি মো. রাশেদুল, ভারপ্রাপ্ত এমডি মো. আবেদ হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম এবং বোর্ড সদস্যরা অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণের বিপরীতে কোনো মর্টগেজ ছাড়াই ১০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেন।
এর আগে ২৫ জানুয়ারি পি কে হালদার কেলেঙ্কারিতে ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করে দুদক। ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। গত ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করে ইন্টারপোল। এই কেলেঙ্কারিতে এখন পর্যন্ত ২৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। গ্রেপ্তার হয়েছেন সাতজন। তাঁদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, শংখ বেপারী ও রাশেদুল হক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।