মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আইনজীবী, নিরীক্ষকরা ছিলেন পি কে হালদারের দুর্নীতির সহযোগী

প্রকাশিত: ১১:৩১ এএম, জুলাই ২, ২০২১

আইনজীবী, নিরীক্ষকরা ছিলেন পি কে হালদারের দুর্নীতির সহযোগী

দুর্নীতির রাস্তা সহজ করতে আইনজীবী ও নিরীক্ষকদের হাতে রাখতেন দুর্নীতি মামলার পলাতক আসামি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পি কে হালদার। দুর্নীতি করে আইনি জটিলতা থেকে রক্ষা পেতে হাতে রাখতেন ঘনিষ্ঠ আইনজীবীদের। জালিয়াতিপূর্ণ হিসাব-নিকাশ বৈধ বলে চালানোর জন্য ব্যবহার করতেন নিকটাত্মীয় চতুর নিরীক্ষকদের। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে পি কে হালদারের দুর্নীতির এ নতুন তথ্য। দুদক সূত্র জানায়, দেশের একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লোপাটে পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ নামি আইনজীবী ও নিরীক্ষকদের যোগসাজশ রয়েছে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্যারিস্টার নুরুজ্জামান সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। তার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে পি কে হালদারের। পরে তিনি পি কে হালদারের পরামর্শে সরকারি চাকরি ছেড়ে একটি ল ফার্ম চালু করেন। পি কে হালদারের আশীর্বাদেই তিনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক হন। অনিয়ম, দুর্নীতি থেকে কীভাবে রেহাই পাওয়া যাবে, তারই পরামর্শ দিতেন ব্যারিস্টার নুরুজ্জামান। এর পর তারা মিলেমিশে ওই প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুটে নেন। প্রতিষ্ঠিত নামি নিরীক্ষক নাসিম আনোয়ারের সঙ্গে ছিল পি কে হালদারের গভীর সম্পর্ক। দুর্নীতি করেও নিরীক্ষায় ফাঁক-ফোকর তৈরি করে কীভাবে পার পাওয়া যায়, সেসব উপায় জানাতেন নাসিম আনোয়ার। এসবের প্রতিদান হিসেবে তাকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক করা হয়েছিল। তিনি পি কে হালদারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থ লুটেছেন। দুদকের তদন্ত থেকে জানা গেছে, পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী ছিলেন একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তিনি পি কে হালদারের উপদেষ্টারও (কনসালট্যান্ট) দায়িত্বে ছিলেন। এর বিনিময়ে তাকে মাসিক পাঁচ লাখ টাকা বেতন দেওয়া হতো। পরে উজ্জ্বল কুমার নন্দীকে পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালনে তার কোনো যোগ্যতা নেই- নিজেই তা স্বীকার করেছেন। তাকে আনান কেমিক্যাল, নর্দান জুট মিলস, রাহমান কেমিক্যালের চেয়ারম্যানও করা হয়েছিল। আলোচিত অমিতাভ অধিকারী প্রশাসন ক্যাডারে সরকারি চাকরি করতেন। আইন বিষয়ে তার যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। তিনি পি কে হালদারের খালাতো ভাই। পি কে হালদারের পরামর্শে সরকারি চাকরি ছেড়ে তার মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির এমডি হন। কর আইনজীবী সুকুমার মৃধা পি কে হালদারের আয়কর ও জমি-জমা সংক্রান্ত বিষয় দেখতেন। পেশায় আইনজীবী সুকুমার মৃধার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধাও পি কে হালদার সিন্ডিকেটের সদস্য। তিনি পি কে হালদারের সৃষ্ট অস্তিত্বহীন উইন্টেল ইন্টারন্যাশনালের এমডি। এই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এফএস ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণের নামে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে দুদকের মামলায় বর্তমানে জেলে আছেন। তারা পি কে হালদারের কথামতো অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে কাগজপত্র তৈরি করে তাকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতে সরাসরি সহায়তা করেছেন বলে আদালতে স্বীকার করেছেন। দুদক জানায়, মো. জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও পি কে হালদারের ব্যবসায়িক পার্টনার। তিনি ছিলেন এফএএস ফাইন্যান্সের ভাইস চেয়ারম্যান। মো. সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (এফসিএ)। তিনি ছিলেন পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও এফএএস ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান। পি কে হালদার তাদের সহায়তায় এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ১ হাজার তিনশ কোটি টাকা লুটে নেন। একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, সহজে অপকর্ম চালাতে পি কে হালদার একটি উল্লেখযোগ্য ল ফার্মের সঙ্গে ৩০ কোটি টাকার চুক্তি করেছিলেন। চুক্তি ছিল- তারা পি কে হালদারকে সব ধরনের আইনি সহায়তা দেবে। পি কে হালদার যেন আইনের ফাঁদে না পড়েন, সেখান থেকে তাকে রক্ষা করাই ছিল তাদের কাজ। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটে যেন সমস্যা না হয় সে বিষয়ে পি কে হালদার কোটি কোটি টাকা অডিট ফার্মের পেছনে খরচ করেছেন। তাদের সহায়তায় দেশের প্রতিষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং ও অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। একই সঙ্গে শত শত কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছেন। দুদকের তদন্ত থেকে আরও জানা যায়, দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে এখনও অনেক আইনজীবী ও নিরীক্ষক রয়েছেন। সরকার ভালো উদ্দেশ্যে তাদের সেখানে নিয়োগ দিয়ে থাকে। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। তাদের সততা ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। নিরীক্ষকরা ভুয়া প্রতিবেদন দিয়ে বৃহৎ অংকের ঋণ পাইয়ে দিতে সাহায্য করেন। তাদের সহায়তায় পি কে হালদারের মতো আরও অনেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশের ভেতরে ও বাইরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছেন। জানা গেছে, পি কে হালদার দীর্ঘ সময় এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। পিপলস লিজিং ও অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোনো পদে না থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনায় তার প্রত্যক্ষ হাত ছিল। একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে পি কে হালদার ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিরুদ্ধে দুদক ইতোমধ্যে ২০-২৫টি মামলা করেছে। আসামিদের অনেকে কারাগারে আছেন। পি কে হালদার বিদেশে পলাতক। তাকে দেশে এনে আইনের মুখোমুখি করতে ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়েছে দুদক।
Link copied!