অর্থনীতিতে সুখবর মিলছে না গত কয়েক মাস ধরে। প্রবাসী আয় ও রফতানি আয়েও ছিল নেতিবাচক ধারা। বেশি শঙ্কা ছিল রিজার্ভ কমে আসা নিয়ে। রিজার্ভ এখন ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। এই সংকটময় অবস্থায় আশা জাগাচ্ছে রফতানি আয়। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এই একটি মাত্র খাত এখন বড় ভূমিকা রাখছে। এর পাশাপাশি প্রবাসীয় আয় বা রেমিট্যান্সের প্রবাহও বাড়ছে। এই দুই খাত ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভে প্রাণ ফেরাতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী গত নভেম্বর মাসে (একক মাস হিসাবে) দেশের ইতিহাসে রফতানি আয়ের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এক মাসে পাঁচ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রফতানি আয় এর আগে দেশ কখনো অর্জন করতে পারেনি। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সামগ্রিক রফতানি আয়ে মোট প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর একক মাস হিসেবে শুধু নভেম্বর মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এই সময়ে মোট রফতানি আয়ের ৮৬ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তৈরি পোশাক রফতানি ও প্রস্তুতকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান জানান, পোশাক খাতের রফতানি আয়ের এই প্রবৃদ্ধির ধারা সামনের আরও কয়েকটি মাস অব্যাহত থাকবে।
ইপিবি সূত্রে জানা গেছে, পণ্য চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে যেসব প্রধান অনেকগুলো রফতানি পণ্যের উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে মোট প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৬১ ভাগ। পোশাক শিল্পের দুই খাতের মধ্যে ওভেনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং নিটওয়্যার পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এ ছাড়া প্লাস্টিক পণ্যে প্রবৃদ্ধি ৪১ দশমিক ২৪ শতাংশ, চামড়াজাত পণ্যের প্রবৃদ্ধি ২৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ, মসলাজাত পণ্যে প্রবৃদ্ধি ২৬ দশমিক ৭১ শতাংশ, মাছ রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, সিমেন্ট রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ, তামাক ও তামাকজাত পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ১২৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ, মানুষের মাথার চুল রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ৫৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং সিরামিক পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
ইপিবি প্রকাশিত নভেম্বরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মূলত পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধিই গত মাসের রফতানি আয়ে একাধিক ইতিবাচক রেকর্ড বয়ে এনেছে। মোট ৫০৯ কোটি ২৫ লাখ ডলারের রফতানির মধ্যে শুধু নিট ও ওভেন পণ্য রফতানি থেকে আয় এসেছে ৪৩৭ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ মোট রফতানির ৮৬ শতাংশই এসেছে পোশাক খাত থেকে। সাধারণত সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রফতানির ৮২-৮৩ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে।
নভেম্বর শেষে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোট রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে মোট রফতানি হয়েছে দুই হাজার ১৯৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৯৭৯ কোটি।
সামগ্রিক রফতানির তথ্যে দেখা যায়, কৃষিপণ্য খাতে এ পাঁচ মাসে রফতানির পরিমাণ মাত্র ৪২ কোটি ৮৯ লাখ ডলার যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ শতাংশ কম। চামড়া ও চামড়াজাত খাতে আয় এসেছে ৫৩ কোটি ৭৫ লাখ ডলার যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। পাট ও পাটজাতপণ্যের রফতানি আয় ৪০ কোটি ৬৬ লাখ ডলার যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ শতাংশ কম।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দুই হাজার ১৯৪ কোটি ৬০ লাখ (২১.৯৪ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন দেশের বিভিন্ন খাতের রফতানিকারকরা। লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ২১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে পণ্য রফতানি থেকে ১৯ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এ হিসাবেই প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ। রফতানিতে ইতিহাস গড়ে এক মাসে পাঁচ বিলিয়নের বেশি আয় হয়েছে নভেম্বরে।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য বড় খাতগুলোর মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই খাত থেকে জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৫৩ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। পাট ও পাটজাতপণ্য রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৪০ কোটি ৬৬ লাখ ডলার।
তবে অন্যান্য খাতের মধ্যে এই পাঁচ মাসে হোম টেক্সটাইল রফতানি কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। কৃষিপণ্য রফতানি কমেছে ২৩ শতাংশ। হিমায়িত মাছ রফতানি থেকে আয় কমেছে ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ওষুধ রফতানি থেকে আয় কমেছে ১৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এসেছে প্রায় ১৯ কোটি ডলার। এ ছাড়া জুলাই-নভেম্বর সময়ে স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রফতানি থেকে ৪০ দশমিক ৬৪ শতাংশ, বাইসাইকেল ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং হ্যান্ডিক্রাফট রফতানি থেকে ২৪ দশমিক ১৪ শতাংশ রফতানি আয় কম এসেছে।
গত প্রায় চার মাস ধরে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট কারণে উৎপাদন ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাহত হওয়ার কথা বলে আসছিলেন রফতানিকারকরা। আবার ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে পোশাক রফতানির সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ-আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ায় ক্রয়াদেশও কমে আসছিল বলে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছিল। ব্যবসায়ীদের এসব পূর্বাভাসের সঙ্গে মিল রেখে টানা ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধিতে থাকা রফতানি হোঁচট খায় গত সেপ্টেম্বরে এসে; আগের মাসের মতো অক্টোবরেও আগের বছরের একই মাসের চেয়ে রফতানি আয় কমে যায়। তবে নভেম্বরে এসে রফতানি আয়ে গতি আসায় স্বস্তি প্রকাশ করছেন রফতানিকারকরা।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘বৈশি^ক নানা সংকট ও দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে বিগত কয়েক মাস পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক ধারা ছিল। বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন রফতানি আদেশ কমিয়ে দিয়েছিল ৩০ শতাংশের বেশি। পুরোনো অর্ডারও বাতিল করেছিল অনেক ক্রেতা। এখন সে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। প্রচুর অর্ডার আসছে, তাই কারখানাগুলোতে কাজের কোনো অভাব নেই। তবুও কাঁচামালের মূল্য বেড়ে যাওয়া, উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরি ও কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতের মতো নতুন বাজারে রফতানি বাড়ার ফলে নভেম্বরে রফতানিতে ভালো সাফল্য এসেছে। আগামী কয়েক মাসও রফতানি আয়ের এ সাফল্যের ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশা করছি।’
এদিকে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি চরম সংকট চলছে। ডলারের বাজারে অস্থিরতা, বিগত কয়েক মাস রফতানি আয় ও প্রবাসী আয় কম হয়েছিল। এ কারণে ক্রমাগত হারে কমে আসছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বলা হচ্ছে রিজার্ভ এখন নেমে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। প্রকৃত রিজার্ভ কিন্তু আরও কম। সুতরাং এই ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভে প্রাণ ফেরাবে রফতানি আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধি। তবে সরকারকে মাথায় রাখতে হবে যেন রফতানি বাণিজ্যের এই ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট যেন দূর করা হয় শিল্প কারখানায়।