গ্রাম-শহরের মনিহারি বা মুদি দোকানে সাদা পলিথিনে মোড়ানো ঝুলছে চিপসের প্যাকেট। মোড়কের গায়ে নেই কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা, মূল্য বা পণ্যের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ। কিন্তু প্যাকেটের ভেতরে আছে ৫০০ এবং ১ হাজার টাকার হুবহু নতুন জাল নোট। বোঝারই উপায় নেই ওই নোট আসল নাকি নকল। এসব নোটের আকার-আকৃতি, রং, জলছাপ, ক্রমিক নম্বর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নামযুক্ত স্বাক্ষরসহ সবকিছুই আসল নোটের মতোই অবিকল। শুধু টাকার গায়ে লাল হরফে ছোট করে লেখা আছে নমুনা টাকা।
দোকানিরা বলছেন, বাজারে নতুন এসেছে এ চিপসটি। শিশুদের আকর্ষণ বাড়াতে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান চিপসের ভেতরে নকল টাকার এ নোট দিয়েছে। শিশুরা ওই টাকা পেলে খুশি হয়। তাই এ চিপস বিক্রিও বেশি হয়। আর পুলিশ বলছে, এটা প্রতারণার নতুন ফাঁদ। বাজারে জাল টাকা ছড়ানোর কাজে এবার শিশুপণ্যকে টার্গেট করা হয়েছে। পুলিশ এর বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে।
সরেজমিন দেখা যায়, মেহেরপুরের প্রায় সব মুদি ও মনিহারি দোকানে বিক্রি হচ্ছে এ জাতীয় গুটি চিপস। এটি খাদ্যপণ্য হলেও প্যাকেটের গায়ে উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, কোম্পানির নাম, মূল্য, পণ্যের ধরন বা উৎপাদন পদ্ধতি কিছুই লেখা নেই। একটা বড় প্যাকেটের ভেতর ১০টি চিপসের গোলাকার প্যাকেট। সঙ্গে আছে ২০টি ৫০০ ও ১০০০ টাকার নকল নতুন নোট। দোকানিরা প্রতি প্যাকেট চিপস ৩ টাকায় কিনে বিক্রি করছে ৫-৭ টাকায়। বাজারে প্রচলিত চিপসের মধ্যে এটাই সবচেয়ে কম মূল্যের। আবার সঙ্গে পাচ্ছে হাজার টাকার জাল নোট। তাই বিক্রি যেমন বেশি, তেমনি এ চিপস বিক্রি করে দোকানিদের লাভও বেশি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিশুপণ্যের মধ্য দিয়ে জাল টাকা ছড়ানোর পর সেই টাকা আসল টাকার বান্ডিলের মধ্যে ঢুকিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সর্বত্র। একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ কাজটি করছে। যারা চিপস বিক্রির পর নানা উপায়ে শিশুদের কাছ থেকে জাল নোটগুলো সংগ্রহ করে। এভাবে একপক্ষ লাভবান হলেও প্রতারিত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। মেহেরপুরের গাংনীর কুঞ্জনগর গ্রামের চাষি আশরাফুল ইসলাম জানান, তিনি বামুন্দি হাটে পাট বিক্রি করেন ১০ হাজার টাকায়। বাড়ি ফিরে ওই টাকার মধ্যে দুটি ৫০০ টাকার নমুনা নোট খুঁজে পান। পরে নতুন ও চকচকে ওই নোট নিয়ে দোকানে গিয়ে জানতে পারেন নোটটি আসল নয়, নকল।
গাংনীর কাথুলী ইউনিয়নের ধলা গ্রামের সবজি বিক্রেতা মনিরুল আলম জানান, তিনি সম্প্রতি মেহেরপুর হাটে পেঁপে ও কাঁচা মরিচ বিক্রি করে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। পরে সেই টাকার ভেতর তিনটি ৫০০ এবং একটি ১ হাজার টাকার জাল নোট পান।
জেলার কাজিপুর ও হাড়াভাঙ্গা বাজারের রাজিয়া স্টোর, স্বপন স্টোর ও পাতা স্টোরে ব্যাপক হারে পাওয়া যাচ্ছে এসব চিপস। দোকানগুলোর মালিকরা বলেন, বিএসটিআইয়ের অনুমোদনবিহীন এই চিপস শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ কি না তা তারা জানেন না। আবার চিপসের মাধ্যমে বাজারে জাল টাকা ছড়াচ্ছে, যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সেটাও জানেন না দোকানিরা।
ভাটপাড়া গ্রামের মুদি দোকানি লোকমান হোসেন বলেন, ‘লাভ বেশি তাই এ চিপসগুলো বিক্রি করি। এ চিপস বিক্রি করতে একজন হকার বাইরে থেকে এসে একদিন অর্ডার নিয়ে যায়। অন্যদিন এসে সরবরাহ করে।’
জেলা শহরের বামনপাড়ার রাজিয়া স্টোরের মালিক কাবের উদ্দিন বলেন, ‘প্রথমদিকে এ চিপসটি কিনতে ওরা আমাদের নানাভাবে উৎসাহিত করে। এখন চাহিদা বাড়ায় আমরাও অর্ডার দিই। ওরা মাল দিয়ে যায়। কোথা থেকে আসে জানি না।’
চিপসের প্যাকেটে জাল টাকা দেওয়ার পর থেকে বাজারে জাল টাকার সরবরাহ বেড়েছে বলে জানান মুদি ব্যবসায়ী হারুন আলী। তিনি বলেন, ‘বাজারে জাল নোট বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বেশি টাকার কিছু বিক্রি করলে নোট যাচাই করে নিই। গত তিন মাসে পাঁচটি জাল নোট পেয়ে আমার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
চিপসের প্যাকেটে জাল টাকা সরবরাহের বিষয়ে জানতে চাইলে গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী খানম বলেন, ‘বিষয়টি আমি অবগত নই। খোঁজ নিয়ে দেখব।’
তবে মেহেরপুর জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা রিয়াজ মাহমুদের দাবি, তারা নতুন এ প্রতারণা রোধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে কয়েকটি দোকানে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে। এসব খাবার যাতে বাজারজাত করতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। তবে নমুনা টাকার বিষয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
আর জেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর তাজিমুল হক বলেন, ‘চিপসের সঙ্গে জাল টাকা ছড়ানোর বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে কদিন আগে সদর উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর তরিকুল ইসলাম বিষয়টি আমাকে জানালে আমি মাঠপর্যায়ে দ্রুত খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’
বিএসটিআইয়ের অনুমোদনবিহীন এসব চিপস শিশুদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন মেহেরপুরের সিভিল সার্জন নাসির উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘বিএসটিআই অনুমোদনবিহীন এসব ভাজাপোড়া খাবার শিশুদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর। এগুলো খাওয়া থেকে শিশুদের বিরত রাখা উচিত।’
এ ধরনের অনুমোদনবিহীন শিশুখাদ্য ও বাজারে জাল টাকার বিস্তার রোধে পুলিশের পক্ষ থেকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিরুল ইসলাম বলেন, ‘শিশুদের চিপসের ভেতর অবিকল টাকা ব্যবহারের বিষয়টি পুলিশের নজরে এসেছে। অনেকে এমন শিশুখাদ্য বিক্রি বন্ধের দাবি করেছে। ইতিমধ্যে জাল টাকাসহ চিপস বিক্রির অপরাধে কয়েকজন মুদি ও মনিহারি ব্যবসায়ীকে আটক করে পরে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ জাল টাকা ছাপানোর রুট বের করতে সরবরাহকারী ব্যবসায়ী চক্রটিকে ধরার চেষ্টায় আছে।’