শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একটি বাসের আয়ের গল্প

প্রকাশিত: ১২:৩৯ পিএম, ডিসেম্বর ৪, ২০২১

একটি বাসের আয়ের গল্প

ভাড়া বাড়ানোর পরও বাসমালিকেরা বলছেন তাদের লাভ হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। একটি বাসে যে পরিমাণ আসন থাকার কথা তার চেয়েও বেশি আসন বসিয়েছেন, ভাড়াও নিচ্ছেন বেশি। তা হলে মালিকেরা কেন এমন কথা বলছেন। একটি মিনিবাসে সাধারণত আসন থাকে ৩২টি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এমন বাসে ২০ শতাংশ আসন বাদ রেখে অর্থাৎ ২৬টি আসন ধরে ভাড়া নির্ধারণ করে। সুতরাং গড়ে তাদের এই ২৬টি আসনের ভাড়া পাওয়ার কথা। বিহঙ্গ পরিবহনের বাস চলাচল করে মিরপুর ১২ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত। এই রুটের দূরত্ব ১৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার। একজন যাত্রী যদি এই বাসে মিরপুর ১২ থেকে সদরঘাটে যান, এরপর আবার তিনি মিরপুর ১২ নম্বরে ফিরে আসেন, তা হলে তার সরকার নির্ধারিত ভাড়া দিতে হবে ৭৮ টাকা। সেই হিসাবে এই মিনিবাসে ২০ শতাংশ আসন বাদ রেখে ২৬টি আসনের ভাড়া পাওয়ার কথা। এতে যাওয়া-আসা মিলে এই দূরত্বে আয় হওয়ার কথা ২ হাজার ২৮ টাকা। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সরেজমিন দেখা গেছে, ৩২ আসনের এই বাসে বাড়তি আসন বসানো হয়েছে ৮-১০টি বেশি। একটি নির্ধারিত স্থান থেকে গন্তব্যে যাওয়া ও সেখান থেকে ফিরে আসাকে এক ট্রিপ বলা হয়। এই ট্রিপের ভিত্তিতেই একটি বাসের আয়-ব্যয়ের হিসাব কষেন মালিক-শ্রমিকরা। এমন প্রেক্ষাপটে চলুন এই বাসের আয়ের হিসেব করা যাক। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন এই প্রতিবেদক। ওঠার পর দেখা যায়, ওই বাসে বসার মতো আসন রয়েছে ৪২টি। (কিছু বাসে আবার ৪৬টি আসনও দেখা গেছে) বিআরটিএর হিসাবের বাইরে আরও ১০টি আসন বাসিয়েছেন বাসমালিক। একই সঙ্গে দাঁড়ানো যাত্রী ছিল ১৩ জন। ফলে বাসটি মোট যাত্রী বহন করছিল ৫৫ জন। বেশি যাত্রী ছিল ২৩ জন। শুধু তাই নয়, প্রায় সব যাত্রীর কাছ থেকে ৫-১০ টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করছিলেন কন্ডাক্টর। দাঁড়ানো কোনো যাত্রী না নিয়ে শুধু ৩২ আসনে যাত্রী নিয়ে যদি বাসটি এক ট্রিপ দেয় তা হলে সরকার নির্ধারিত চার্ট অনুযায়ী তার আয় হবে ২৪৯৬ টাকা। বাড়তি ভাড়া পাচ্ছেন ৪৬৮ টাকা। কিন্তু কন্ডাক্টর ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পরিবহনের একটি বাস প্রতিদিন ৪-৫টি ট্রিপ দেয়। চার ট্রিপ ধরে হিসাব করলেও এই বাসের প্রতিদিন এই বাসের সর্বনিম্ন আয় হয় ৯ হাজার ৯৮৪ টাকা। কিন্তু এই প্রতিবেদক যে বাসটিতে উঠেছিলেন, সেই বাসটিতে ওই সময় ৫৫ জন যাত্রী ছিল। ভাড়াও ৫-২০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছিল। বাসটি যদি গড়ে ৫০ জন যাত্রী নেয়, গড়ে ৭ টাকা বেশি ভাড়া আদায় করে এবং এক দিনে ৪টি ট্রিপ দেয়, তা হলে তার আয় দাঁড়ায় ১৭ হাজার টাকা। কিন্তু ২৬ আসন ধরে হিসাব করলে আয় হওয়ার কথা ৮১১২ টাকা। কিন্তু প্রকৃত আয় হলো ১৭ হাজার টাকা। বাড়তি আয় হয় ৮ হাজার ৮৮৮ টাকা। তবে যাত্রী ও ট্রিপ কম-বেশি হলে এই আয়ও কম-বেশি হবে। তবু বাসমালিকরা বলছেন তাদের আয় কম হয়। এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক এই টাকা থেকে বাসমালিক কত টাকা পান। বিহঙ্গ পরিবহনের ওই বাসের কন্ডাক্টর রুবেল বলেন, ভোর সাড়ে ৪টায় বাসটি সিরিয়াল দিই। এরপর সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চালাই। মাঝে দুপুরের খাওয়ার বিরতি। বাকি সময় বাসের মধ্যে থাকতে হয়। প্রতি ট্রিপে আমরা পাই ১২০ টাকা ও ড্রাইভারের ১৮০ টাকা। দুপুরের খাবার ১০০ টাকা। তেলের খরচ আমাদের দিতে হয়, ৩০০০-৩৫০০ টাকা। বাকি টাকা পায় মালিক। কিছুদূর পর পর যাত্রী চেক করার জন্য মালিকের লোক থাকে, তাদের দিতে হয় ১০-২০ টাকা। সেই চেকের হিসাবে যে টাকা জমা আসে তা মালিক নিয়ে নেয়। তিনি বলেন, তবু সন্ধ্যার পর যদি আপনি দেখেন মালিক আর ড্রাইভার কী রকম গ্যাঞ্জাম লাগে। কী ব্যবহার করে বুঝতে পারতেন। মালিক বলে, তোকে এই টাকা ভাড়া কাটতে বলেছি, তুই এই টাকা কাটছস কেন? এদিকে ড্রাইভার-কন্ডাক্টরের বাইরে মালিকের খরচ হয় পুলিশের সার্জেন্টের মাসিক চাঁদা, মালিক সমিতির চাঁদা, যা প্রতি মাসে ৭-৯ হাজার টাকা। এই চাঁদার অর্থ যোগান দিতে মালিক-শ্রমিকরা বেশি ভাড়া আদায় করে থাকেন যাত্রীদের কাছ থেকে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদৃশ্য ব্যয় ও চাঁদাবাজির অর্থ ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘সিস্টেমের কারণে ঢাকার মতো জনবহুল একটা শহরে বাসের ব্যবসা লাভজনক নয়। এটা আমার কথা নয়, তিনটি স্টাডি করা হয়েছে সবগুলোতেই একই তথ্য পাওয়া গেছে। কেন হচ্ছে এমনটা? এর জন্য দায়ী এই মালিক সমিতির নেতারাই। কারণ একেকটা করিডরে একাধিক কোম্পানির বাস নামিয়েছে। যেখানে কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। বাস নিয়ে আসছে, সরকার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। আবার যানজট ও বিশৃঙ্খলা রয়েছে। ফলে একটা বাসের যে প্রোডাক্টিভিটি, বেশি ট্রিপ দেওয়া, সেটা কমে যায়। কিন্তু মালিক তার টাকাটা নিয়ে যায়। যদি বেশি ট্রিপ দেওয়া যায় তা হলে শ্রমিকদের কাছে বেশি টাকা থাকবে। কিন্তু যখনই যানজটের কারণে ট্রিপ কমে যায় তখনই চালক-ড্রাইভার উগ্র হয়ে যান। বেশি ভাড়া আদায় করেন। হাফ পাস চাইলে তারা মনে করে, তার পেটে লাথি লাগছে। এ কারণে তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যান।’
Link copied!