শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এফডিআরের নামে টাকা আত্মসাৎ যমুনা লাইফের

প্রকাশিত: ১২:০৬ পিএম, মার্চ ২৩, ২০২৩

এফডিআরের নামে টাকা আত্মসাৎ যমুনা লাইফের

জালিয়াতি বা ছলচাতুরির মাধ্যমে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে জীবন বিমা কোম্পানি যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে। এফডিআর বা মেয়াদি আমানতের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছে না কোম্পানিটি। মাসে মাসে কোনো মুনাফাও দিচ্ছে না। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার ৯৩ জন গ্রাহকের কাছ থেকে ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা তুলেছে যমুনা লাইফ। এক বছরে ৯ শতাংশ হারে মুনাফা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে বিপুল এই অর্থ তুলে নেয় কোম্পানিটি। পরে সেই টাকাগুলো গ্রাহকদের না জানিয়ে ১৫-২০ বছর মেয়াদি বিমা পলিসি করে ফেলে যমুনা লাইফ। এতে প্রতারণার শিকার হয়েছেন গ্রাহকরা। কোম্পানিটির দাবি, সব গ্রাহক যমুনা লাইফে বিমা করেছেন। ফলে অর্থ ফেরত না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন গ্রাহকরা। চট্টগ্রামে যারা এফডিআর করেছেন তাদের একজন রিপন বড়ুয়া। দীর্ঘদিন পর প্রবাস থেকে ফিরে নিজের সঞ্চিত কয়েক লাখ টাকা ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে রেখেছিলেন তিনি। মুনাফাও ভালো পাচ্ছিলেন। হঠাৎ দুই বছর আগে তার বাসার উল্টো পাশের বাসায় বসবাস করা যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কর্মী মোহাম্মদ রায়হানের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে রায়হান রিপনকে একদিন জানান, তাদের কোম্পানি একটি এক বছর মেয়াদি এফডিআরের অফার দিচ্ছে। সেখানে ৫ লাখ টাকা রাখার জন্য মাসে প্রতি লাখের জন্য ১ হাজার ৪০০ টাকা করে মুনাফা দেয়ার কথাও জানান। অতিরিক্ত লাভের আশায় রিপন এরপর ৫ লাখ টাকা দেন। রিপন বড়ুয়া বলেন, ‘এফডিআরের বিপরীতে প্রতি মাসেই লাখপ্রতি তারা ১ হাজার ৪০০ টাকা মুনাফা আমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। এক বছর যাওয়ার পর আমি আমার মূল টাকা তুলতে গেলে তারা আমাকে আরও এক বছর রাখতে বলেন। তারা বলেন, এখন থেকে প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা করে মুনাফা দেব। আমি আর তাদের কিছু বলিনি এবং টাকাও তুলিনি। ছয় মাস ঠিকঠাক মুনাফা দেয়। এরপর মুনাফা দেয়া বন্ধ হয়ে গেলে কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে আমি বুঝতে পারি প্রতারণার শিকার হয়েছি। তারা জাল কাগজপত্র বানিয়ে এফডিআরকে বিমায় রূপান্তর করেছে। রায়হানকে বারবার বিষয়টি জানিয়েও সমাধান পাইনি। এখন আমি আর মুনাফা নয়, আমার মূল টাকাটা ফেরত চাই।’ চট্টগ্রামে আরও যারা এফডিআর করেছেন তাদের আরেকজন স্কুলশিক্ষক বদিউল আলম। এক বছরের জন্য প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা মুনাফা দেয়ার আশ্বাস দিয়ে সাড়ে ৬ লাখ টাকার এফডিআর করার জন্য অর্থ নেয় যমুনা লাইফ। বদিউল আলম প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম অনুযায়ী রাজধানীর রূপালী ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকে যমুনা লাইফের অ্যাকাউন্টে মোট সাড়ে ৬ লাখ টাকা জমা দেন। প্রথম আট মাসে তাকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা দেয় যমুনা লাইফ। এরপর টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয় কোম্পানিটি। বদিউল আলম পরবর্তী সময়ে কোম্পানিটিতে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয় তার পুরো টাকা ২০ বছরের জন্য জীবন বিমা পলিসি করা হয়েছে। অথচ তার কাছ থেকে এফডিআর করার শর্ত দিয়ে টাকা নেয়া হয়েছিল। যমুনা লাইফ সে সময় এফডিআর-সংক্রান্ত এক সার্কুলার প্রকাশ করেছিল। সেই সার্কুলারে বলা হয়, এককালীন এফডিআরের ওপর ইনসেনটিভ ঘোষণা করা হলো। এ বিষয়ে বদিউল আলম বলেন, ‘মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে টাকা নিয়েছে যমুনা লাইফ। আমাকে না জানিয়ে ২০ বছরের জন্য সাড়ে ৬ লাখ টাকার বিমা করেছে যমুনা লাইফ। অথচ ৯ শতাংশ সুদে এক বছরের জন্য টাকা জমা দিয়েছিলাম। যমুনার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কামরুল হাসান খন্দকারের সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, যমুনার এজেন্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে। আমি তো যমুনা লাইফের অ্যাকাউন্টেই টাকা জমা দিয়েছিলাম। তাহলে কেন এমডি এখন এ কথা বলবেন। এ রকম অব্যবস্থাপনায় তিনিও (এমডি) দায়ী।’ যমুনা লাইফের এমডি কামরুল হাসান খন্দকারের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছি, বিকেলে কল দেন, তখন কথা বলব।’ এরপর টানা তিন দিন একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। চট্টগ্রামে স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা যায়, ২০২০ সালের নভেম্বরে এক সার্কুলার দেয় যমুনা লাইফ। যেখানে উল্লেখ থাকে এফডিআর করলে সুদ দেয়া হবে। এই সার্কুলার দেখিয়ে যমুনা লাইফের এজেন্টরা বাড়তি সুদ দেয়ার আশ্বাস দিয়ে লোকজনকে এফডিআর করতে বলে। যমুনা লাইফ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চট্টগ্রামে গিয়েও সাধারণ মানুষদের এফডিআর করতে বলেন। এর মধ্যে অন্যতম যমুনা লাইফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক জসিম উদ্দিন ও সহকারী উপব্যবস্থপনা পরিচালক রবিউল ইসলাম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই দুজন চট্টগ্রামে প্রতারণার প্রধান হোতা। চট্টগ্রামে সরেজমিন দেখা যায়, বিমা করার নির্ধারিত বয়স পার হয়ে গেলেও এমন অনেকজনকে বাড়তি সুদ দেয়ার আশ্বাস দিয়ে জাল সনদপত্র ও ভোটার আইডি নিজেরাই তৈরি করেছে যমুনা লাইফ। ৬৫ বছর বয়সী একজনকে জাল সনদ বানিয়ে বয়স পঞ্চাশের কম করা হয়। আবার অনেকের কর্মস্থলের নাম পরিবর্তন করে অন্য প্রতিষ্ঠানের ভুয়া সনদপত্র তৈরি করেছে যমুনা লাইফ। এ রকম অসংখ্য গ্রাহকের জাল সনদ বানিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে বেসরকারি এ বিমা কোম্পানিটি। একাধিক এজেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কামরুল হাসান খন্দকারের নির্দেশে তারা অসংখ্যজনের কাছ থেকে এফডিআরের কথা বলে গ্রাহকদের নির্ধারিত অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে বলেন। এসব গ্রাহক কয়েক মাস কোম্পানি থেকে মুনাফা পেলেও একসময় সেটা দেয়া বন্ধ করে দেয় যমুনা লাইফ। এজেন্ট এবং গ্রাহকদের কোনো কিছু না জানিয়ে তাদের টাকা ১৫-২০ বছর মেয়াদি জীবন বিমা পলিসি করে দেয়। একাধিক এজেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখন এমডি এজেন্টদের দোষারোপ করছেন। অথচ এমডি এফডিআরে মুনাফার কথা বলে অ্যাকাউন্ট খোলাতে বলেছেন। যমুনা লাইফের এমডি, সাবেক অতিরিক্ত এমডি, ভাইস চেয়ারম্যানসহ কোম্পানিটির কয়েকজন কর্মকর্তা এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। কারণ গ্রাহকদের সবাই এফডিআরএর টাকা যমুনা লাইফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছেন। কোম্পানি থেকেই এজেন্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে কোম্পানিতে এফডিআর করা হলে ৯ শতাংশ সুদ দেয়া হবে এবং এক বছর পর পুরো অর্থ ফেরত দেয়া হবে। পরে সেই টাকা একেক জনের দীর্ঘমেয়াদি বিমা পলিসি করা হয়েছে। এতে গ্রাহকদের প্রতারিত করা হয়েছে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘আইডিআরএ একটা অকার্যকর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইডিআরএ যারা নানা সময়ে দায়িত্বে ছিলেন তারাও নানা রকমের অনিয়মের মধ্যে জড়িয়ে গেছেন। কারণ আইডিআরএর দায়িত্ব এসব কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণ করা।’ তিনি বলেন, ‘গ্রাহক এফডিআরের জন্য বিমা কোম্পানিতে অর্থ জমা রাখছে, কোনোভাবেই তাকে না জানিয়ে কিংবা গ্রাহকের অনুমতি ছাড়া বিমা পলিসি নেয়া যাবে না। কোনো কোম্পানি এ রকম করলে তার লাইসেন্স বাতিল করে দেয়া উচিত।’ তাড়নার শিকার হওয়া গ্রাহকরা যমুনা লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল হাসান খন্দকার, অতিরিক্ত সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসিম উদ্দিন, সহকারী অতিরিক্ত ব্যবস্থপনা পরিচালক রবিউল ইসলাম, উন্নয়ন ও প্রশাসন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইদুল হক শামীম- এই চারজনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের আদালতে মামলা করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের মূল হোতা রবিউল ইসলাম। এ ছাড়া সব অনিয়ম কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে এ চারজন কর্মকর্তার মাধ্যমে। প্রতারিত হওয়ার ঘটনায় গ্রাহকদের করা মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ ফারুক অবশ্য এ বিষয়ে তেমন কিছু বলতে চাননি। জানতে চাইলে সিআইডির এই কর্মকর্তা দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা যাবে না।’ এসব গ্রাহক আইডিআরএতে লিখিত চিঠির মাধ্যমে অভিযোগ জানিয়েছেন। তবে আইডিআরএ এখনো কার্যত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। এ বিষয়ে আইডিআরএর পরিচালক ও মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আইডিআরএ কাজ করছে। পর্যালোচনা করে আপনাদের জানানো হবে।’ শুধু গ্রাহকদের নয়, কোম্পানিটি নিজেদের কর্মীদের সঙ্গেও প্রতারণা করেছে। তাদের একজন হলেন সাজু দাশ। তিনি কোম্পানির চট্টগ্রাম শাখায় ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ছিলেন। শাখা ব্যবস্থাপক হলেও তিনি মূলত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অধীনেই ছিলেন। তাদের দেয়া শর্ত অনুযায়ী সাজু বিভিন্নজনের কাছ থেকে কখনো এফডিআর, কখনো ডিপোজিট পেনশন স্কিমের (ডিপিএস) নামে কোম্পানিকে টাকা এনে দিয়েছেন। এসবের জন্য কোম্পানির নিয়মে কমিশন থাকলেও কখনো সেটি পাননি সাজু। সাজু দাশ বলেন, ‘আমাদের ওপর গ্রাহক বাড়ানোর চাপ থাকত। সে জন্য নিজের অন্তত ১৪ জন আত্মীয়ের কারও ১ লাখ, কারও ২ লাখ ও কারও ৫ লাখ টাকা নিয়ে কোম্পানিতে জমা দিয়েছি। কোম্পানির শর্ত অনুযায়ী আত্মীয়দের বলেছিলাম তাদের প্রতি মাসেই ভালো অঙ্কের মুনাফা দেয়া হবে। আর টাকা আনার বিপরীতে নিয়ম অনুযায়ী আমাদের কমিশন দেয়ার কথা থাকলেও তা কখনো দেয়া হয়নি। আমাকে মাসে কখনো ৫ হাজার, কখনো ১০ হাজার বেতনের নামে দেয়া হতো। একপর্যায়ে গত বছর প্রতারিত কয়েকজন গ্রাহক মামলা করলে আমাকে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়। এই কোম্পানির সঙ্গে বড় বড় মানুষ জড়িত। তাদের দেখে কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলাম, আত্মীয়স্বজনের টাকা এনে দিয়েছিলাম। এখন আমি ফেঁসে গেছি। এখন আত্মীয়রা নিয়মিতই তাদের মূল টাকার জন্য আমাকে বিরক্ত করছেন। এই যন্ত্রণায় বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
Link copied!