‘যারা আমাকে ভালোবাসেন তারা কেউ এহসান গ্রুপ নিয়ে কথা বলবেন না। প্রশ্ন করলেই মনে হবে আপনাদের কোনো সমস্যা আছে। জানার জন্য প্রশ্ন করলে আলাদা বিষয়। আপনি না বুঝলে বোঝানোর রাস্তা খোলা। জমিনে সুদের সবচেয়ে ছোট গুনাহ হলো মায়ের সঙ্গে জেনা করা। কাউকে যদি সরাসরি বলি, তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে জেনা করো কেন, সে রাগ করবে। কিন্তু তার আমলনামায় জেনার গুনাহ লেখা হচ্ছে। এরকম গুনাহ থেকে হেফাজত থাকার জন্য আমার বন্ধুবর আপনাদের এলাকার মানুষ মুফতি রাগীব আহসান সেবামূলক সংগঠন এহসান পরিবার চালু করেছে, যা পিরোজপুর নয়, গোটা জগতের জন্য রহমত।’
প্রতারণার মাধ্যমে ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠা এহসান গ্রুপকে নিয়ে পিরোজপুরে একটি মাহফিলে হাজার হাজার জনতার সামনে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী কুয়াকাটা। তার কথা শেষ হওয়া মাত্র দর্শকরা উচ্চস্বরে ‘ঠিক’‘ঠিক’বলে উত্তর দেয়। পরে দর্শকদের উদ্দেশে আবার বলেন, ‘আপনারা ঠিক বললেও ঠিক, না বললেও ঠিক। আমি নিজেই এহসান পরিবারের একজন সদস্য। যারা হারাম খেয়ে অভ্যস্ত, তারা কখনও এ পথে আসতে চাইবে না। এহসানের এই পরিবারের সঙ্গে চলেন, এতে দিন দিন বাতির পাওয়ার বেড়ে যাবে। কেউ বন্ধ করতে পারবে না।’
ধর্মের নামে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করে হাজার হাজার মানুষের সামনে এহসান গ্রুপের গুনগান করে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করা হতো ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের। সুদমুক্তভাবে শরীয়াহভিত্তিক নিয়মে বিনিয়োগের কথা বলে আকৃষ্ট করা হতো। ধর্মকে ব্যবহার করে ওয়াজ মাহফিলে এক শ্রেণির আলেমের এমন কর্মকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রকৃত আলেমরা। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর তোপখানা রোড থেকে এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রতারক রাগীব আহসান ও তার সহযোগীকে গ্রেফতার করলে প্রতিষ্ঠানটির অভিনব এমন প্রতারণার বিষয়টি জনসমক্ষে আসে।
প্রকৃত আলেম ও অপরাধ গবেষকরা বলেন, ধর্মকে পুঁজি করে প্রতারণা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ বহু পুরনো হলেও এহসান গ্রুপের প্রতারণা ছিল অনেক ভয়াবহ। যারা প্রকাশ্যে ওয়াজ মাহফিলে সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করেছে তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এদিকে, প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার তিনজনের বিরুদ্ধে পিরোজপুর সদর থানায় প্রতারণার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে পুলিশ।
শোলাকিয়া ঈদগাহর খতিব মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, প্রকৃত আলেমরা হারামমুক্ত জীবনযাপন করে। যারা ওয়াজ মাহফিলে মানুষকে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎ করে, তারা প্রকৃত আলেম নন। এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ভুক্তভোগীদের একজন পিরোজপুরের রানীপুরের মনি আক্তার বলেন, ২০১০ সালে নূরে মদিনায় সাত বছরের জন্য ডিপিএস খুলে ১২ লাখ টাকা জমা করি। নির্ধারিত সময় শেষে লাভসহ ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও সময় শেষ হলেও কোনো টাকা দেয়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, তোপখানা রোড এলাকা থেকে রাগীব আহসান ও তার ভাই মো. আবুল বাশারকে (৩৭) গ্রেফতার করেছে র্যাব। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার বিকালে পিরোজপুর সদর থানা পুলিশ শহরতলির খলিশাখালী গ্রামের বাড়ি থেকে আহসানের অপর দুই ভাই মাহমুদুল হাসান ও খায়রুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে।
শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ‘শরিয়তসম্মত সুদবিহীন বিনিয়োগ’-এর প্রচার চালিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে জনগণকে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করতেন। এভাবে আবাসন প্রতিষ্ঠান, দোকান ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কথিত বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে এক লাখের বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে কোনো গ্রাহক টাকা ফেরত চাইলে তাকে নির্যাতন করা হতো। আত্মসাৎ করা টাকার বেশিরভাগই সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন রাগীব আহসান।
র্যাব আরও জানায়, তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ভুক্তভোগীদের করা ১৫টি মামলা চলমান রয়েছে। ২০১৯ সালে একবার গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তবে জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের প্রতারণা শুরু করেন। তার আত্মসাৎ করা টাকা জঙ্গি কর্মকান্ডে বা বিভিন্ন ইস্যুতে উসকানির কাজে ব্যবহৃত হতো কি না সেগুলো খতিয়ে দেখছে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, প্রকৃত আলেমদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সোচ্চার হলে ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা বন্ধ করা সম্ভব হবে।
ওয়াজ মাহফিলে উদ্বুদ্ধ করা আলেমদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাগীব অনেক আলেম-ওলামাকে দিয়ে মাহফিল করিয়ে বা মাহফিলে হাজির করে তার পক্ষে কথা বলিয়েছেন। দেশি আলেমদের বাইরে বিদেশ থেকে কেউ এলে তাদের দিয়েও এহসান গ্রুপের গুনগান করিয়েছেন। এক্ষেত্রে কোনো বক্তা যদি সরাসরি কাউকে প্রভাবিত করে এবং প্রতারণার শিকার কোনো ভুক্তভোগী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেন তবে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ধরনের প্রতারণায় পুলিশের করণীয় প্রসঙ্গে সাবেক অ্যাডিশনাল আইজিপি মোখলেসুর রহমান বলেন, মানুষ প্রকাশ্যে অনেক মুখরোচক কথা বলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ব্যক্তির তালিকা করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারে এবং আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। একই সঙ্গে মানুষ যেন এ ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পা না দেয় সে জন্য সচেতন করতে পারে।
পিরোজপুর সদর থানার এসআই মনিরুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতার তিনজনের বিরুদ্ধে প্রতারণার তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। মামলার বাদী ভুক্তভোগী গ্রাহক হারুন-অর-রশিদ জানান, মাওলানা রাগীব আহসান ২০১০ সালে প্রথমে এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স নামে একটি কোম্পানি খুলে ধর্মের নামে প্রলোভন দেখিয়ে এবং অধিক মুনাফা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বিনিয়োগ করিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করে।
এহসান গ্রুপের পক্ষে কাজ করার বিষয়ে কথা বলার জন্য মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিকী কুয়াকাটাকে এই প্রতিবেদক একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।