বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কফিনের সঙ্গে তাঁরা নিয়ে গেলেন বুকভরা বেদনা

প্রকাশিত: ০৮:২৩ এএম, আগস্ট ৫, ২০২১

কফিনের সঙ্গে তাঁরা নিয়ে গেলেন বুকভরা বেদনা

অভাবের সংসারে তাঁদের বেড়ে ওঠা। স্বজনদের নিয়ে একটু সচ্ছলতার সঙ্গে বাঁচতে কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন তাঁরা। হঠাৎ আগুনে পুড়ে নিজেদের সঙ্গে শেষ হয়েছে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তাঁদের সেই লড়াই। তবে যাঁদের তিল তিল কষ্টে উপার্জনের পথে গিয়েছিলেন তাঁরা, সেই মানুষগুলো এখন নিঃস্ব। প্রিয়জনের কফিনের সঙ্গে বিগত দিনের স্মৃতিগুলোই সঙ্গী হয়েছে তাঁদের। মাসখানেক আগে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় ভয়াবহ আগুনে নিহত ২৪ জনের লাশ বুধবার বুঝে পেয়েছেন স্বজনেরা। দুপুরে যখন একে একে কফিনবন্দী লাশগুলো বুঝে নিচ্ছিলেন তাঁদের মা–বাবা, ভাই ও বোনেরা, সেই সময় হাহাকার ছাড়া তাঁদের কাছ থেকে আর কিছুই বের হচ্ছিল না। দেখে চিনতে না পারার মতো এই লাশগুলোর তালিকায় ছিল ১৭ বছরের কিশোর রিপন মিয়া। এসএসসি পাস রিপন সংসারে সহযোগিতার জন্য পাঁচ মাস আগে কাজ নিয়েছিল এই কারখানায়। দুই ভাই ইসমাইল ও ইব্রাহীম এবং মা লিলি বেগমকে নিয়ে ছিল তাঁদের সংসার। দুপুরে রিপনের লাশ বুঝে নেওয়ার সময় বিলাপ করছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব লিলি বেগম। তিনি বলছিলেন, ছেলে তাঁর কবিতা লিখত। স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে কবি হবে সে। কলেজ বন্ধ থাকায় কাজ করতে গিয়েছিল। তা–ই কাল হলো তাঁর আদরের সন্তানের। তিনি বলেন, ‘ছেলে আমার আর কোনো দিন কবিতা লিখবে না। আবৃত্তির ঢংয়ে সেই কবিতা আর আমাকে পড়ে শোনাবে না।’ লিলি বেগম জানান, তাঁদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। ছোট ছেলে রিপনের বয়স যখন দেড় বছর, সেই সময় ওদের বাবা চলে যান, খোঁজখবর নেন না। এরপর তিন শিশু ছেলেকে নিয়ে গাজীপুরে চলে আসেন। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে ছেলেদের খাওয়াপরার ব্যবস্থা করেন। একপর্যায়ে সেখানে পোশাক কারখানায় কাজ নেন। পাঁচ–ছয় বছর আগে রূপগঞ্জে আসেন তাঁরা। লিলি বেগম বলেন, কাজ করেই তিন ছেলেকে এসএসসি পাস করিয়েছেন। বড় ছেলে ইসমাইল এখন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেন। ইব্রাহীম আর রিপন কলেজে পড়ত। রিপন রূপগঞ্জের একটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল। সংসারে অভাব থাকায় পাঁচ মাস আগে সে হাসেম ফুডস কারখানায় কাজ নেয়। সে কাজ করত কারখানার চতুর্থ তলায়। ওই দিনের ঘটনা স্মরণ করে বেদনাহত এই মা বলেন, কারখানায় আগুন লাগার পর পাঁচ মিনিটের মাথায় খবর পেয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি সেখানে ছুটে যান। চোখের সামনে দেখেন আগুনের লেলিহান শিখা আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী। অন্য দিন রিপন সঙ্গে মুঠোফোন নিলেও সেদিন নেয়নি। সেদিন থেকে রিপনকে খুঁজছিলেন তাঁরা। পাগলের মতো লিলি বেগম একবার কারখানার সামনে আসেন, আরেকবার যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কোথাও খুঁজে না পেয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিএনএ নমুনা দেন লিলি বেগম। সম্প্রতি সিআইডির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাঁর ছেলের মরদেহ শনাক্ত হয়েছে। একইভাবে ছোট মেয়ে ফারজানার মরদেহ পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন কিশোরগঞ্জের ঝর্ণা আক্তার। তিনি জানান, তাঁর তিন মেয়ে, এক ছেলে। অভাবের সংসারে ছোট মেয়ে ফারজানা (১৪) ছয়–সাত মাস আগে এই কারখানায় কাজ নেয়। বেতন পেত পাঁচ হাজার টাকা। ফারজানা বেতনের বড় অংশই মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিত। কারখানায় আগুন লাগার পর সেদিন ফারজানা তার মা ঝর্ণা আক্তারকে ফোন দেয়। পাঁচ সেকেন্ডের সেই ফোন কলে ফারজানা শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিল, ‘মা, ধোঁয়া, দম নিতে পারছি না।’ এরপর ঝর্ণা আক্তার মেয়ের খোঁজে একবার হাসেম ফুডসের কারখানায় সামনে যান, আরেকবার আসেন ঢাকা মেডিকেলে। সেই মেয়ের মরদেহ পাওয়ার পর তাঁর দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। ঝর্ণা আক্তার বলেন, যাঁদের জন্য এতগুলো মানুষের মৃত্যু হলো, তাঁদের শাস্তি দিতে হবে। শাস্তি দিতেই হবে। গত ৮ জুলাই হাসেম ফুডসের ওই কারখানায় আগুনে নিহত হন ৫২ জন। ৩ জনের লাশ তখনই শনাক্ত হয়। বাকিদের মরদেহ এতটাই পুড়ে ছিল, সেগুলো দেখে চেনার উপায় ছিল না। তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে নেওয়া হয়। স্বজনদের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা শেষে ৪৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। বুধবার তাঁদের ২৪ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। বাকি ২১ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হবে আগামী শনিবার।
Link copied!