মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে চাকরি দেয়ার নামে ভয়ঙ্কর প্রতারণা

প্রকাশিত: ০৫:০৮ এএম, মে ১১, ২০২১

করোনাকালে চাকরি দেয়ার নামে ভয়ঙ্কর প্রতারণা

অনলাইনে চাকরির আকর্ষণীয় বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন সিরাজগঞ্জের নাঈম ইসলাম। তিনি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর একটি আলিয়া মাদ্রাসার আলিম ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান নাঈম ওই এলাকায় টিউশনি করে তার পড়ালেখার খরচ চালাতেন। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মনে মনে একটি চাকরি খুঁজেন তিনি। ফেসবুকে বিজ্ঞপ্তি দেখেন এসএসসি/এইচএসসি পাসেই আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি। আবেদনের এক ঘণ্টা পরেই তাকে ফোন করা হয়। পরের দিন সকালে ইন্টারভিউর জন্য ডাকা হয় তাকে। সরল মনে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় ইন্টারভিউয়ের জন্য যান নাঈম। ইন্টারভিউয়ের শুরুতেই বলা হয়, একটি ফরম পূরণ করতে হবে তার জন্য দিতে হবে এক হাজার টাকা। আপনি তো নতুন তাই ৭ দিনের একটি ট্রেনিং করতে হবে। তার জন্য আপনাকে ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। ভালো-মন্দ না বুঝে এই ভয়ঙ্কর ফাঁদে পা দেন নাঈম। এ সময় ফরম পূরণের জন্য এক হাজার টাকা দিয়ে দেন। আর কাছে টাকা না থাকায় এক/দুইদিন পর ট্রেনিংয়ের জন্য আরো ৫ হাজার টাকা দেয়ার কথা বলেন তিনি। পরে শতভাগ চাকরি দেয়ার আশ্বাসে দুইদিনের মধ্যে টাকা দিয়ে ট্রেনিংয়ে যোগ দেয়ার কথা বলা হয়। দুইদিন পর বোনের কাছে ধার করে ৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে ট্রেনিং শুরু করেন নাঈম। তবে ২-৩ দিন যাতায়াত করে চোখ খুলে তার। বুঝতে পারেন তিনি বড় ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। শুধু নাঈম নন, করোনা সংকটের সময় এমন অনেক শিক্ষিত যুবক চাকরির আশায় প্রতারকদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পত্রিকা ও লিফলেটের মাধ্যমে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে চাকরি দেয়ার নামে এমন প্রতারণা রাজধানীতে অহরহ চলছে। তবে করোনায় অনেক মানুষ চাকরি হারানোর কারণে এসব ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। চাকরি দেয়ার নাম করে শুধু প্রতারণাই নয়, সেই সঙ্গে ফাঁদে ফেলে মেয়েদের ব্যবহার করা হচ্ছে নানা অনৈতিক কাজে। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি গ্রামের অল্প শিক্ষিত মানুষও এসব প্রতারকদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে। এসব প্রতারণার দুই একটি অভিযোগ কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পৌঁছে। প্রতারণার দায়ে কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হন। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় এসব অপকর্মের মূল হোতারা। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীতে চাকরি দেয়ার নামে অসংখ্য ভুয়া প্রতারক চক্র গড়ে উঠেছে। ভয়ঙ্কর এসব প্রতারকদের কেউ পোশাক কারখানায়, সিকিউরিটি গার্ডসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি দেয়ার নামে বেকার তরুণ-তরুণীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে তাদের চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সরল-সোজা বেকার যুবক-যুবতীরা চাকরির আশায় আবেদন করেন। চাকরির আশ্বাস দিয়ে ১-২ মাসের প্রশিক্ষণের কথা বলে তাদের কাছে চাওয়া হয় টাকা। যারা টাকা দেন তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ঠিকই, কিন্তু চাকরি দেয়ার কোনো খবর থাকে না। এভাবে এক সময় অধিকাংশরাই কোনো উপায় না পেয়ে বাড়ি ফিরে যান। এরমধ্যে দুই-একজন যারাই ধৈর্য ধরে থাকেন তাদেরকে কোনো ছোটখাটো কোম্পানিতে অল্প বেতনে চাকরি দেন। প্রতারণার শিকার হওয়া নাঈম এ প্রতিবেদককে জানান, প্রতারণার শিকার হয়ে তিনি বেশ কিছুদিন হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। কোনো উপায় না পেয়ে অবশেষে গ্রামে চলে যান। এর আগে তিনি বিষয়টি তার বন্ধুদের জানালে এ বিষয়ে খোঁজখবর নেয়ার জন্য কয়েকজন মতিঝিলের ওই অফিসে যান। পরিচয় গোপন করে তারা চাকরি করতে ইচ্ছুক বলে জানালে চাকরির বিনিময়ে তাদের কাছেও টাকা চাওয়া হয়। পরে নাঈমের নাম বললে তারা তাকে চেনেন না বলে জানান সেখানকার ম্যানেজার। পরে সেখানে আসা অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যেকের কাছ থেকেই ট্রেনিং করানোর নামে ৫ হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে। টাকা দিয়ে চাকরি না হলেও অধিকাংশরা লোক লজ্জার ভয়ে অথবা টাকার পরিমাণ খুব বেশি না সে জন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে চান না। নাঈম বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালাতাম। করোনার সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি খোঁজা শুরু করি। ফেসবুকে বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেখে মনে হলো সহজেই চাকরি পেয়ে যাবো। তাই আবেদন করি। ওরা আবদনের পরের দিনই আমাকে কল করে ডেকে নিয়ে আমার সঙ্গে এভাবে প্রতারণা করেছে। কাছে টাকা না থাকায় বোনের কাছ থেকে ধার করে টাকা দিয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি চাকরি দেয়ার নামে এরা ঢাকা শহরে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। গ্রামের সরল সোজা মানুষ না বুঝে তাদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে। এত বড় প্রতারণা মেনে নেয়া যায় না। এসব প্রতারকদের শাস্তি হওয়া উচিত। প্রশাসন কি এদের দেখে না? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করা রাজশাহীর আনোয়ার হোসেন। তিনিও সম্প্রতি একই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তিনি জানান, ‘চাকরির খবর’ নামের একটি ফেসবুক পেজে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করি। আবেদন করার ১ ঘণ্টা পরেই আমাকে তারা কল করে। আমি তখন তাদের কাছে নিয়োগ প্রক্রিয়া জানতে চাই। এ সময় তিনি বলেন, সিকিউরিটি গার্ডের সুপারভাইজার পদে আপনি নিয়োগ পাবেন। মূল বেতন ১৭ হাজার। সঙ্গে মোবাইল ও যাতায়াত খরচসহ মাসে ৩ হাজার টাকা এবং একটি বাইক দেয়া হবে। এখন আপনি আগ্রহী হলে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র নিয়ে অফিসে আসতে হবে। তাদের কথামতো আমি গাজীপুরে তাদের অফিসে যাই। পরে তারা আমাকে একটি ফরম পূরণ করতে বলেন। ফরম পূরণ করলে আমার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নেয়া হয়। এরপর তারা বলেন, আগামী সাতদিন আপনাকে ট্রেনিং নিতে হবে। এরপর ১ তারিখ থেকে জয়েন। সেজন্য ট্রেনিং বাবদ ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। কিন্তু আমার কাছে ছিল ২ হাজার টাকা। তখন তারা বলেন- আপাতত ২ হাজার দেন বাকিটা পরে দিলেও হবে। বিষয়টি আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হলে তাদেরকে বলি আগামীকাল আসবো। পরে বুঝতে পারি এটা ভুয়া। তিনি বলেন, সে সময় অনেক ছেলেমেয়েকে সেখানে দেখলাম, যারা টাকা দিয়ে দিয়েছেন। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, তাদেরকে সেখানেই সাতদিন রাখা হবে। আসলে ট্রেনিং বলতে কিছু নেই। শেষ পর্যন্ত যারা থাকবে তাদেরকে সুপারভাইজার নয়, ৭-৮ হাজার টাকা বেতনে হয়তো সাধারণ গার্ডের চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। মাঝখান থেকে তারা চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়।
Link copied!