শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা-পরবর্তী হজে এসেছে যেসব পরিবর্তন

প্রকাশিত: ১২:৫২ পিএম, জুন ১০, ২০২২

করোনা-পরবর্তী হজে এসেছে যেসব পরিবর্তন

ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম হজ। হজই একমাত্র শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ইবাদত। হজ মানবেতিহাসের অন্যতম প্রাচীন ইবাদত। অসংখ্য নবীর স্মৃতিবিজড়িত আবেগ ও আধ্যাত্মিকতাময় ইবাদত। মুসলিম উম্মাহর আদি পিতা ইবরাহিম (আ.) পুত্রকে নিয়ে কাবাগৃহ নির্মাণের পর থেকে নিয়মিত চলে আসছে হজ। তবে ইতিহাসের নানা বাঁকে কোনো কোনো বছর বাধাগ্রস্ত বা সীমিত হয়েছে হজ। আধুনিক যুগে গত দুই বছর খুবই সীমিত আকারে হজ অনুষ্ঠিত হয়েছে বৈশি^ক মহামারি কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে। গেল দুই বছর শুধু সৌদিতে অবস্থানকারীদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে হজব্রত পালনের। তিন বছর আগে সারা বিশে^র যে মুমিন বান্দারা হজের জন্য রেজিস্ট্রেশন করে অধীর অপেক্ষায় ছিলেন, তাদের প্রতীক্ষার অবসান হচ্ছে এ বছর। চলতি সপ্তাহে শুরু হয়েছে বায়তুল্লাহর মুসাফিরদের হজযাত্রা। ৫ জুন বাংলাদেশ থেকে সরকারি ব্যবস্থায় প্রথম কাফেলা জিদ্দায় অবতরণ করে। জিদ্দার কিং আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং মদিনার মুহাম্মদ বিন আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দৈনিক বিভিন্ন দেশ থেকে নতুন নতুন কাফেলা অবতরণ করছে। তাদেরকে ফুল ও সুবাস ছিটিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছে। হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে পবিত্র জমজমের পানির বোতল, উন্নত খেজুরসহ নানা উপহার সামগ্রী। মহামারির এ ধাক্কায় পৃথিবীর আর অনেক কিছুর মতো হজ ব্যবস্থাপনায়ও এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। এবার যারা হজে যাচ্ছেন তারা অনেক কিছুই পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত দেখতে পাবেন। সন্দেহ নেই আল্লাহর ইচ্ছায় আগের চেয়ে অনেক পরিপাটি ও স্বচ্ছন্দ হতে যাচ্ছে এবারের হজ। ইতোমধ্যে যারা লাব্বাইক ধ্বনি মুখে নিয়ে আল্লাহর নবীর দেশে পা রেখেছেন তারা সবাই দেখতে পাচ্ছেন শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যের ঝলক। পরিবর্তিত হজের উল্লেখযোগ্য দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে- হাজীদের কোটা : করোনা শুরুর আগের বছর ২০১৯ সালে হজে অংশগ্রহণ করেন ২.৫ মিলিয়ন (২৫ লক্ষাধিক) মুসলিম। ২০২০ সালে করোনার প্রথম বছর মাত্র ১ হাজার স্থানীয় মুসলিমকে নিয়ে হজ অনুষ্ঠিত হয়। করোনার দ্বিতীয় বছর গেল ২০২১ সালে ভ্যাকসিন নেওয়া সাপেক্ষে ৬০ হাজার সৌদি ও সৌদিতে অবস্থানকারী মুসলিমকে নিয়ে হজ অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর ১ মিলিয়ন (১০ লাখ) মুসলিমকে নিয়ে হজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রতিবছর সারা বিশ্বের দেশগুলোর জন্য হাজীদের কোটা নির্ধারণ করে থাকে সৌদি আরব। করোনার আগে সবশেষ বছরগুলোয় বাংলাদেশের জন্য সোয়া ১ লাখের কিছু বেশি হাজীর কোটা বরাদ্দ থাকত। এবার বাংলাদেশ থেকে ৫৭ হাজার ৫৮৫ জন পবিত্র হজ পালনের সুযোগ পাচ্ছেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৪ হাজার ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৫৩ হাজার ৫৮৫ জন হজে যাচ্ছেন। বয়সের সীমা : স্বাভাবিক সময়ে যেকোনো বয়সি সক্ষম নারী-পুরুষ হজে যেতে পারতেন। শিশু ও বৃদ্ধরাও স্বজনদের সঙ্গে হজ করতেন। কিন্তু করোনা-পরবর্তী এ বছর হজের জন্য বয়স বেঁধে দেওয়া হয়েছে। পনেরো থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে বয়সিরাই শুধু হজের সুযোগ পাচ্ছেন। প্যাকেজে খরচ বৃদ্ধি : প্রতিবছর সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হজের চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ঘোষণা করা হয় সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজের প্যাকেজ। করোনা-পূর্ববর্তী হজগুলো মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যেই ছিল। দুই বছর পর প্রতীক্ষিত হজ প্যাকেজ ঘোষণা হলে অনুমানকেও ছাড়িয়ে যায় এর ব্যয়। ২০১৯ সালে সর্বনিম্ন যে প্যাকেজ ছিল ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা, বৈশি^ক মূল্যস্ফীতিময় বছরে তা এবার নির্ধারিত হয়েছে সরকারি ব্যবস্থাপনার প্যাকেজ-১-এ ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪০ টাকা এবং প্যাকেজ-২-এ জনপ্রতি ৫ লাখ ২১ হাজার ১৫০ টাকা। ব্যতিক্রমী ঘটনা হলো, প্রথমে প্যাকেজ ঘোষণার পর আবার তাতে ৫৯ হাজার টাকা যোগ করা হয়। ফলে অনেকেই বাধ্য হন এ বছর হজে না গিয়ে আগামী বছরের জন্য অপেক্ষায় থাকতে। অবস্থানকাল হ্রাস : প্রতিবছর মক্কা-মদিনা মিলিয়ে হজের সফর হতো সর্বোচ্চ দেড় মাস বা ৪৫ দিন, এবার সেটা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১ মাস থেকে ৩৫ দিন। সাধারণত সর্বনিম্ন এক সপ্তাহ সময়ে হজ করে আসা যায়। হজের মূল কার্যক্রম মূলত ৮ জিলহজ থেকে ১৩ জিলহজ পাঁচ দিন। টিকা ও ভ্যাকসিন : করোনা শুরুর আগে হজযাত্রীদের শুধু ম্যানিনজাইটিস/ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা দিতে হতো। এ বছর এসবের সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন। করোনাভাইরাসের পূর্ণ ডোজ টিকা নেওয়া থাকতে হবে। এই টিকা হতে হবে সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ট্র্যাকার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী সৌদি আরব মডার্না, ফাইজার বায়োএনটেক, জনসন অ্যান্ড জনসন ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার অনুমোদন দিয়েছে। এই ৪টি টিকার বাইরেও সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক টিকা যারা নিয়েছেন তারাও হজে যেতে পারছেন। তবে তাদের বুস্টার ডোজ হিসেবে মডার্না, ফাইজার, জনসন বা অ্যাস্ট্রাজেনেকার অন্তত এক ডোজ টিকা নেওয়া থাকতে হবে। এ ছাড়া সৌদির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করার আগের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ সনদ সঙ্গে রাখতে হবে হজযাত্রীদের। নানা বিধিনিষেধ : হজ-উমরার সফরে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ থাকে আল্লাহর ঘর স্পর্শ করা, জান্নাতি পাথর হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করা এবং মদিনার মসজিদে নববীতে দুনিয়াতে জান্নাতি টুকরো রওজা শরিফ বা রিয়াজুল জান্নাতে নামাজ আদায় করা। করোনার বাধার পর উমরা উন্মুক্ত হলেও এখনও কাবাঘরের চারপাশের ব্যারিকেড বহাল রয়েছে। রওজা শরিফে প্রবেশের জন্য অনলাইনে নির্দিষ্ট অ্যাপ থেকে রেজিস্ট্রেশন করে নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে প্রবেশ করতে হচ্ছে। আসন্ন হজের দিনগুলোতে কাবাঘরের চারপাশের ব্যারিকেড সরানো হবে এমন কোনো ঘোষণা এখন পর্যন্ত আসেনি। ফলে সম্ভবত এবার হজে আল্লাহপ্রেমিকরা নবীজি (সা.) যে কালো পাথরে চুম্বন করেছেন, তাকে চুম্বন বা স্পর্শ করার সুযোগ পাবেন না। তবে মসজিদে নববীর রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশ কিছুটা সহজ করা হবে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থাপনার উন্নতি : দুই বছর বিরতির সুযোগে মক্কার মসজিদে হারাম এবং মাশায়েরে হজ তথা হজের বিশিষ্ট স্থানগুলোতে ব্যাপক সংস্কার ও উন্নয়ন কার্যক্রম সাধিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা মসজিদে হারামের নতুন তৃতীয় সম্প্রসারিত কিং আবদুল্লাহ অংশের কাজ প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। এর অত্যাধুনিক সুরম্য স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী আগত মুসল্লিদের চোখে মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। সুউচ্চ ও মনোরম আবদুল আজিজ ও ফাহাদ গেটের নির্মাণকাজও শেষের দিকে। হজের বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয় ঐতিহাসিক মিনা প্রান্তরে। হাজীদের মিনায় অবস্থানের তাঁবুগুলো প্রতিবছরই উন্নত করা হয়। এ বছর সেখানে প্রায় সবখানেই সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। উন্নত খাট ও বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরাফার তাঁবুগুলোতে এসি যুক্ত করা হয়েছে এবং মুজদালিফায় প্রথমবারের মতো তাঁবু ও এসির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া টয়লেট ও অজু-গোসলের ব্যবস্থা অনেক উন্নত করা হয়েছে। ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাও বিগত বছরগুলোর তুলনায় স্বস্তি ও আরামদায়ক হবে। চারদিকে সাজ সাজ রব : সারা বিশ্ব থেকে আগত দুয়ুফুর রহমান বা আল্লাহর অতিথিদের স্বস্তিদায়ক চলাফেরা ও আয়োজন নির্বিঘ্ন করার জন্য গত সপ্তাহ থেকেই মক্কা ও মদিনা এবং এর আশপাশ এলাকার বাইরের লোকদের এসব এলাকায় প্রবেশ জিলহজ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মক্কা-মদিনার প্রবেশপথসহ দেশময় হাজীদের স্বাগত জানিয়ে বিভিন্ন বিলবোর্ড ও প্ল্যাকার্ড টানানো হয়েছে। আশপাশের সড়ক ও বিল্ডিংগুলো সুসজ্জিত করা হয়েছে। মক্কার প্রবেশদ্বার বিখ্যাত কোরআন গেট এবং মদিনার প্রবেশদ্বারে জাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনা ও সাজসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি নানা ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন স্থানে সুপেয় পানি ও উপহার সামগ্রী উন্মুক্ত বিতরণ করা হচ্ছে। অন্যান্য প্রস্তুতি : ইতোমধ্যে সৌদি কর্তৃপক্ষ হজ ব্যবস্থার সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ করেছে। আরাফার খুতবা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ ও সরাসরি বিশ্বজুড়ে সম্প্রচারসহ নানা নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনাগত প্রস্তুতিতে সরগরম এখন পবিত্র ভূমি মক্কা ও মদিনা। ৮ জিলহজ প্রতিবছর কাবাঘরের গিলাফ পরিবর্তন করা হয়। এবারও তা যথারীতি একই তারিখে অনুষ্ঠান করতে ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি চ‚ড়ান্ত করা হয়েছে। আল্লাহর রহমতে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ৮ জুলাই ঠিকঠাক মতো হজ অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে ইনশাল্লাহ। ইসলাম বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক
Link copied!