মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রমেই দূরে সরছে ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা

প্রকাশিত: ১২:২৯ পিএম, আগস্ট ১৩, ২০২২

ক্রমেই দূরে সরছে ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট এখন আর নেই। মহাজোটের একটি বড় অংশ জাতীয় পার্টি এখন সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করছে। সঙ্গত কারণে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন রয়েছে কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় জোট। তবে ১৪ দলীয় জোটও মাঠে নেই। ঘরোয়া দুয়েকটি বৈঠক ছাড়া আর কোনো কর্মসূচি দৃশ্যমান নেই। বরং জোটের শরিকরা সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে মানববন্ধন ও বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, শরিকরা কি দূরে সরে যাচ্ছে? এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এখন কোনো মহাজোট নেই। মহাজোটের প্রশ্নই আসে না। এই মহাজোট ছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে। এটা ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নির্বাচনি জোট। এমনকি আগামীতেও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো চিন্তা নেই। আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার লক্ষ্যে দলীয় আদর্শ নিয়ে পার্টিকে গোছাচ্ছি। জেলা-উপজেলায় কমিটি করছি। সম্মেলন করছি। আমরা সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করছি। এখন শুধু সংসদেই নয়, মাঠেও আছি সরকারের গণবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। শুক্রবারও আমাদের সভা ছিল, সেখানেও সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছি। তাই মহাজোট বলে এখন আর কোনো শব্দ নেই। এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। এখন জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধীদল। তা ছাড়া ইতোমধ্যে যেসব স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে, সেখানে কিন্তু জাতীয় পার্টির প্রার্থীর প্রতীক লাঙ্গল ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রতীক নৌকা মুখোমুখি অবস্থানে থেকে নির্বাচন করেছে। এতে প্রমাণ হয়, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের দূরত্ব কতটুকু। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট পুনর্গঠন বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবে যাবেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমরা পার্টিকে শক্তিশালী ও সুসংহত করার চেষ্টা করছি। পার্টির শক্তি বৃদ্ধিতে কাজ করছি। তবে এই মুহূর্তে আমরা সার্বিক পর্যবেক্ষণ করছি। তারপর সিদ্ধান্ত সূত্র বলছে, ১৪ দল কোন কৌশলে এগুচ্ছে, সেটি এখনও পরিষ্কার নয় শরিক দলগুলোর কাছে। গত ১৫ মার্চ গণভবনে বৈঠকে আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে শরিকদের প্রত্যেককে আসন দেওয়ার কথা জোট নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করলেও এমন কোনো লক্ষণ নেই। ফলে ১৪ দলে ক্ষোভের সঙ্গে বাড়ছে হতাশা। গত ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর শরিক দলগুলোর একাধিক নেতাকে মন্ত্রী করা হয়। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর শরিকদের মন্ত্রিসভায় আর রাখা হয়নি। এ ছাড়াও ছোট ছোট কিছু চাওয়া পাওয়া থাকে শরিকদের। সেগুলোও পূর্ণ হয় না। এ নিয়ে শরিকদের মধ্যে রয়েছে চাপা কষ্ট, ক্ষোভ ও দুঃখ। বুক ফেটে গেলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না তারা। এতে করে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বাড়ছে জোটে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের এক জরুরি সভায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় জোটের শরিকরা আন্দোলনকে কীভাবে দেখছে আওয়ামী লীগ- এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট নির্বাচনি জোট। এই জোট তাদের নির্বাচনি অ্যালায়েন্স, কৌশলগত জোট। এখানে আদর্শের কোনো বিষয় নেই। জোটের শরিকদের দলগতভাবে কর্মসূচি দেওয়ার অধিকার আছে। তারা করতে চাইলে করবে। তা হলে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আমরা কেন জোট করেছি? এসব ব্যাপার তো ভাবতে হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ১৪ দল গঠিত হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটি মনে হয়, এখন আর তেমন নেই। ১৪ দলীয় জোটের সব কিছুই নির্ভর করে আওয়ামী লীগের ওপর। কারণ আওয়ামী লীগ এখন আর ১৪ দলকে খুব একটা প্রয়োজন মনে করে না। ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে আমরা বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করেছি। একটা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। কোনো ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচিও নেই। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জোট নেত্রী ১৫ মার্চ বৈঠকে আমাদের ১৪ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ থাকবে এমন আশ্বাস দিলেও এখনও অনেকটা অস্পষ্ট। কারণ আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো কিছুই হয় না। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না রাখলে, আমরা এককভাবে প্রার্থী দেব। এ সরকারের পতন চান কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মেনন বলেন, না আপাতত এ সরকারের পতন চাই না। কেন্দ্রীয় ১৪ দলের শরিকদের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নেই কোনো কর্মপরিকল্পনা ও যুগপৎ কর্মসূচি। জোটের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এখনও কোনো আলোচনা নেই। মাঝেমধ্যে দুয়েকটি ঘরোয়া বৈঠক ছাড়া আর কোনো কর্মসূচিও নেই। ১৪ দল যেহেতু একটি আদর্শিক জোট তাই ঐক্যবদ্ধ আছে। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি ও সরকারের যে নীতি তাতে ১৪ দল কতদূর এগুবে সেটি বলা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ কিছুটা একলা চলো নীতি অনুসরণ করছে। যেটি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল। জোট নিয়ে তাদের আগামী দিনের কৌশল কী তাও পরিষ্কার নয়। ফলে জোটের ভেতরে ভেতরে অনেক নেতাই ক্ষুব্ধ। বাড়ছে দূরত্বও। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খান সময়ের আলোকে বলেন, ১৪ দলীয় জোট অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি আদর্শিক জোট। এটি ঐক্যবদ্ধ আছে, থাকবে। তবে একটি জোটে থাকলেও যে কিছু ছোট ছোট চাহিদা পূরণ করতে হয়, সেটি হয় না। এতে ১৪ দলের মধ্যে কিছু পাওয়া না পাওয়ার ক্ষোভ তো আছেই। সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া জোটের বর্তমান হালহকিকত সম্পর্কে সময়ের আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় জোটে কোনো টানাপড়েন নেই। বরং ১৪ দল ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড় বছর বাকি রয়েছে। তবে আগামী নির্বাচন ১৪ দল কীভাবে মোকাবিলা করবে, তা নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আশা করি ১৪ দল একটি সিদ্ধান্তে যাবে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, কেন্দ্রীয় ১৪ দল আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর নেতৃত্বে ১৪ দলের কর্মসূচি রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে আগামী ২৪ আগস্ট ১৪ দল কর্মসূচি নিয়েছে। তাই ১৪ দলে কোনো ঘাটতি নেই। বরং ১৪ দল ঐক্যবদ্ধ ও অত্যন্ত শক্তিশালী। এটি একটি আদর্শিক জোট। এটা কোনো নির্বাচনি জোট নয় যে সহজেই ভেঙে যাবে। আর নতুন করে কোনো জোটও করবে না আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় জোট নিয়ে কোনো টানাপড়েন নেই। বরং ১৪ দল আরও শক্তিশালী। এই জোট মুক্তিযুদ্ধের ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার। ১৪ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ। তবে তারা বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলতেই পারে। এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তারা তো জোট ত্যাগ করেনি। বাতিলও করেনি। তারা মতামত দিতেই পারে। অতএব এখানে সন্দেহ বা সংশয়ের কোনো কারণ নেই। ১৪ দল অটুট আছে। অটুট থাকবে। এখানে কমিটমেন্টের বিষয়। ১৪ দল ঐক্যবদ্ধ। উল্লেখ্য, গত ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মহাজোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। এরপর আর তাকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। এ সময় ঢাকা-৮ আসনে এমপি হন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। পরে ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর মেননকে সর্বদলীয় সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী করা হয়। পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের তিনি ঢাকা-৮ আসন থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মহাজোট সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মন্ত্রিসভায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে টানা সাত বছর ছিলেন। তিনি এখন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। পরে তাকে আর মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। এরপর আর ১৪ দলের শরিকদের কাউকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি।
Link copied!