শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গবেষণা‘সিঙ্গেল’ নারী-পুরুষের গন্ধ কি আলাদা?

প্রকাশিত: ০৯:৪১ এএম, ডিসেম্বর ২২, ২০২১

গবেষণা‘সিঙ্গেল’ নারী-পুরুষের গন্ধ কি আলাদা?

ডেইলি খবর ডেস্ক: সুগন্ধী ব্যবহারে আসক্ত ছিলেন ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই। প্রতিদিন ভার্সাই প্রাসাদ সাজানো হতো তাজা ফুলে, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে ফোয়ারার পানিতেও ছেটানো হতো পারফিউম। প্রসাদে আসা অভিজাত দর্শনার্থী, রাজদূতদের তো প্রায় ভিজিয়ে দেওয়া হতো সুগন্ধী ছিটিয়ে। বাতিক হোক বা উন্মাদনা- গন্ধ যে মানব জীবনে অসীম গুরুত্বের। লুই নিজের মতো করে হলেও সেটি বুঝেছিলেন। বিবিসির সর্বাধিক পঠিত এক প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের গন্ধ শরীরের খুঁটিনাটি অনেক বিষয়কে তুলে ধরে। রোগবালাই থাকলে তারও সঙ্কেত পাঠায়। যেমন- কারো কলেরা হলে তার শরীর থেকে পচা আপেলের মতো একটি গন্ধ ছড়ায়।তবে গন্ধ মানেই দুর্গন্ধ নয়। কোনোটি করে আকর্ষণ, কোনোটি বা বিরক্তির জন্ম দেয়।অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ্রাণ মনোবিজ্ঞানী মেহমেত মাহমুদ বলেন, 'শরীরের গন্ধ খাদ্যাভাসের মাধ্যমে প্রভাবিত হতে পারে। আমরা মজার এক তথ্য আবিষ্কার করেছি। অনেক গবেষক এর সাথে একমত না হলেও, ওই গবেষণায় দেখা গেছে- আপনার মাংসাহার বেশি হলে গায়ের গন্ধও অন্য লিঙ্গের মানুষের জন্য সুখকর/ স্বস্তিদায়ক হবে।' আরো আছে জৈবিক পরিবর্তনের ভূমিকা। যেমন নারীরা ঋতু চক্রের ফলিকিউলার স্তরে সবচেয়ে বেশি উর্বর থাকেন। এসময় তাদের শরীরের ঘ্রাণ পুরুষদের জন্য বেশি আকর্ষণীয়। অন্যদিকে, ঋতুস্রাব চলাকালে তাদের গাত্রগন্ধ পুরুষের জন্য খুব একটা আকর্ষণীয় হয় না।গবেষণার নিবন্ধে বলা হয়, এর সাহায্যে মানব জাতির আদিম পূর্বপুরুষরা গন্ধ বিচারে বংশবিস্তারের উপযুক্ত সঙ্গী নির্বাচন করত। পুরুষের টেস্টোটেরন বা প্রজনন হরমনের মাত্রাও শারীরিক ঘ্রাণকে উন্নত বা নিকৃষ্ট করতে পারে। এভাবে শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও খাদ্যাভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে গায়ের গন্ধও বদলাতে পারে। আবার জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করেও স্বতন্ত্র হয় এটি।আমাদের শরীরের গন্ধও খুব সুনির্দিষ্ট বা অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। তবে যমজদের গায়ের ঘ্রাণ জেনেটিক মিলের কারণে অনেকটাই এক রকম। মায়েরাও অনেক সময় যমজ দুই সন্তানের গন্ধকে আলাদা করতে পারেন না বলে আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে।এব্যাপারে পোলান্ডের ইউনিভার্সিটি অব রোক্লো'র মনোবিজ্ঞানী এবং মানব গন্ধ-সংবেদনশীলতা বিশেষজ্ঞ অ্যাগনিজকা সোরোকোস্কা বলেন, "জিনগত প্রভাবে আমাদের গন্ধ কতটা প্রভাবিত হয় তাই উঠে আসে এ পরীক্ষায়। তাই হয়তো অন্যদের গন্ধ থেকেই আমরা তাদের জেনেটিক তথ্যও শনাক্ত করতে পারি।" এই বিষয়টি অজ্ঞাতসারেই বিশ্লেষণ করে ফেলে মস্তিস্ক। হাজারো বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়েই হয়তো এ ক্ষমতা পেয়ে গেছি আমরা।শরীরের গন্ধ লুকোতে আমরা সবাই মিলে বছরে শত শত কোটি ডলার সুগন্ধীর পেছনে খরচ করে চলেছি। জেনেটিকভাবে নির্ধারিত নিজ শরীরের গন্ধ অনুসারেই আমরা প্রসাধণী ব্যবহার করি।সোরোকোস্কা ও তার সহকর্মীদের গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে, ঘ্রাণ বিচারে আমরা কারো ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত নিতে পারি।অর্থাৎ, ফ্রান্সের রাজা লুই যতই সুগন্ধীর ফোয়ারা ছোটান, অতিথিরা হয়তো বাতাসে শুঁকেই তার ব্যাপারে কোনো না কোনো তথ্য পেয়ে যেতেন। কারণ, আমাদের সক্ষম গায়ের গন্ধকে পারফিউমের মোড়কেও চাপা দেওয়া সম্ভব হয় না।অন্যের শারীরিক গন্ধের এসব তথ্য কী আমাদের কাজে লাগে?এমন একটি গবেষণায় কয়েকজন নারীকে বিভিন্ন পুরুষের ব্যবহৃত টি-শার্ট দেওয়া হয়। এরমধ্যে আকর্ষণীয় বা সুখকর অনুভূতির জন্ম দেয় এমন ঘ্রাণের টি-শার্ট বাছাই করতে বলা হয় তাদের। তাদের পছন্দ-অপছন্দে প্রধান ভূমিকা রাখে হিউম্যান লিউকোসিট অ্যান্টিজেন (এইচএলএ) এর স্বতন্ত্রতা। এইচএলএ হলো আমাদের ক্রোমোজম-৬ নামক এক ধরনের জটিল জিন সমষ্টি। এটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে যুক্ত। এইচএলএ'র বৈশিষ্ট্যকে ঘ্রাণ সংবেদনশীলতার মাধ্যমে শনাক্ত করে নারীরা তাদের পুরুষসঙ্গী বাছাই করেন।বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের এইচএলএ প্রোফাইল অধিকাংশের সাথে না মিললেও, নিকট আত্মীয়-পরিজনদের সাথে কিছুটা মিলে যায়। তবে প্রজনন ও সন্তান জন্মদানে সবচেয়ে ভালো ভিন্ন ধরনের জিনের এইচএলএ প্রোফাইল।সোরোকোস্কা জানান, "জেনেটিকভাবে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পুরুষের গন্ধও তাই আলাদা হয়। তার থাকে ভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, যা হয়তো ওই নারীর নেই। তবে পিতামাতার জিন মিলে সন্তানের আরো ভালো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে।" পরীক্ষায় অংশ নেওয়া নারীরা এর মাধ্যমেই তাদের জন্য আকর্ষণীয় পুরুষের টি-শার্ট বাছাই করেছেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, নারীদের সূক্ষ্ম ঘ্রাণশক্তি তাদের জন্য সেরা জেনেটিক প্রোফাইলের পুরুষ নির্বাচন করতে সক্ষম। পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ ঘ্রাণ নির্ভর হওয়ায় এখানে অজ্ঞাত পুরুষের চেহারা, উচ্চতা বা বয়স সম্পর্কে জানার কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে সেসব আবেদন এর ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারেনি। ঘ্রাণ বিচারে সঙ্গী নির্বাচনের এই সিদ্ধান্তটি কিন্তু সকলে অবচেতন মনেই নেন।জেনেটিক প্রোফাইলের ভিন্নতা মানব মস্তিস্কে কেন আকর্ষণীয় গাত্রগন্ধের অনুভূতি জন্ম দেয় – সেই প্রক্রিয়া এখনো গবেষণাধীন বলে জানান সোরোকোস্কা।তবে তিনি বলেন, "এইচএলএ আমাদের শরীরে ভিন্ন কিছু উপাদান সৃষ্টি করে। ঘামের সাথে নির্গত হওয়ার পর যা আমাদের ত্বকে বাসকারী ব্যাকটেরিয়া খেয়ে হজম করে এবং পৃথক গন্ধের জন্ম দেয়।"তাহলে কী গন্ধের বিচারেই আমরা সব সময় জীবনসঙ্গী নির্বাচন করছি? বাস্তবতা কিন্তু তা সমর্থন করে না। ৩ হাজার ৭০০ জন দম্পত্তির মধ্যে চালানো আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘটনাক্রমে ছাড়া আলাদা এইচএলএ প্রোফাইলের ভিত্তিতে অধিকাংশই জীবনসঙ্গী নির্বাচন করেননি। আসলে জেনেটিক কারণে ভিন্ন শারীরিক গন্ধের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও, বিয়ের ক্ষেত্রে আমরা শুধু গন্ধ-বিচারে সিদ্ধান্ত নেই না। "এইচএলএ আমাদের বিয়ের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত না করলেও, যৌন সম্পর্ককে করে" বলে জানান সোরোকোস্কা।তাই যাদের ঘ্রাণশক্তি দুর্বল বা যারা সে অনুভূতিহীনতায় ভুগছেন তারা সঠিক সঙ্গী বেঁছে নেননি, এবং তাদের দাম্পত্য জীবনও সুখের নয় বলে জানা গেছে মনোবিজ্ঞানী মাহমুদের আরেক গবেষণায়। এটি তিনি জার্মানির ড্রেসডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইলনো ক্রয়ির সাথে করেছেন।অন্যদিকে, ঘটনাক্রমে হলেও যেসব দম্পতির এইচএলএ প্রোফাইলে ভিন্নতা ছিল তাদের যৌন সম্পর্ক ছিল সাবলীল। তাদের মধ্যে রয়েছে সন্তান জন্মদানের তীব্র আকাঙ্ক্ষা।এই সংযোগ পুরুষের চেয়ে নারীর মধ্যেই ছিল বেশি প্রবল। যেসব নারী একই ধরনের এইচএলএ প্রোফাইলের অধিকারী পুরুষের সাথে সংসার করছেন, তাদের বেশিরভাগই শারীরিক সুখহীনতার অভিযোগ করেন।তবে এ ফলাফলকে চূড়ান্ত ধরে নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানীদের আরো অনুসন্ধান চলমান। বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, নারীর এ পছন্দ স্বাভাবিক। যেমন প্রাকৃতিক পরিবেশে সব প্রাণীই পুরুষসঙ্গী নির্বাচন করে। শাবক জন্মদান ও পালনের দায়িত্বও থাকে মায়ের ওপর। তাই জেনেটিকভাবে দুর্বল পুরুষসঙ্গীর সাথে প্রজনন করলে তাদেরই সবচেয়ে বেশি হারানোর ঝুঁকি। তাই স্ত্রী প্রাণী সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারে বেশ সতর্ক। পুরুষের গুণ বিচারেই মনোযোগ থাকে তাদের। এজন্যই ময়ূরীর মন ভোলাতে পেখম মেলে নাচে পুরুষ ময়ূর। অন্যান্য প্রাণীকেও নানাভাবে নেচে, গেয়ে বা উপহার দিয়ে স্ত্রী-সঙ্গীকে আকর্ষণের চেষ্টা চালাতে দেখা যায়।তবে মানুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন হয় সামাজিক কারণেই। নারী-পুরুষ উভয়ে একে-অন্যের আচার-আচরণ, স্বভাব, শারীরিক গঠন, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি বিষয়কে বিচার করেন। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের এই অংশগ্রহণ আমাদের ঘ্রাণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যকে লঘু করে দেয়। আরেকটি গবেষণায় বিবাহিত ও 'সিঙ্গেল' নারী দু'দলই অংশ নেন। বিবাহিতদের তাদের স্বামী এবং সিঙ্গেলদের তাদের সাথে অশারীরিক রোমান্সের (প্লেটনিক) সম্পর্ক রয়েছে এমন পুরুষ বন্ধুর টি-শার্ট আনতে বলা হয়েছিল। সেগুলো অন্য পুরুষদের টি-শার্টের সাথে মেশানোর পর, না দেখে শুধু গন্ধ শুঁকে পছন্দের গন্ধের ভিত্তিতে সেগুলো আলাদা করতে বলা হয়।মাহমুদ জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরিচিত পুরুষের টি-শার্টে লেগে থাকা গাত্রগন্ধকেই বেশি আকর্ষণীয় বলে জানিয়েছেন নারীরা। এর পেছনে ওই পুরুষের টেস্টোটেরনের উচ্চমাত্রা কাজ করতে পারে। এই তথ্য বলছে, কম বয়সী পুরুষের গন্ধের আবেদন বেশি। স্থায়ী বন্ধনে না জড়ানো সিঙ্গেল নারীদের প্রেমিকরাই এ পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নারীকে আকর্ষণ করেছেন। বয়সের সাথে সাথে টেস্টোটেরন হরমোন কমতে থাকে। ৪০ পেরোনো বিবাহিত পুরুষরাও এর শিকার হন। তাদের কাছে তখন সন্তাানের দায়িত্ব নেওয়াসহ অন্যান্য বিষয়ের গুরুত্ব বাড়ে। ঠিক একারণে বিবাহিত এবং সন্তান জন্মদানকারী পুরুষদের টেস্টোটেরনের মাত্রা কম থাকে।গবেষকরা অবশ্য শুধু গন্ধের বিচারে নারী জীবনসঙ্গী বেঁছে নেন, একথা বলছেন না। "মানব সমাজে সঙ্গী বাছাইয়ে ঘ্রাণ-বিচারের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন কমছে। তাছাড়া, বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে আমরা নিজেদের শরীরের গন্ধ ঢাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি"- বলছিলেন বিজ্ঞানী মাহমুদ। তার সাথে একমত পোষণ করে সোরোকোস্কা বলেন,"শুধু ভালো জিনের সঙ্গী চাইলে আপনি গন্ধের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু, বেশিরভাগ মানুষের কাছেই তা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। জ্ঞাতসারে এমন সিদ্ধান্ত খুব কম মানুষই নেন।-সূত্র: বিবিসি
Link copied!