বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গলায় ‘সাংবাদিক’ আইডি বানায় কসমেটিকস!

প্রকাশিত: ১০:৫৩ এএম, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২১

গলায় ‘সাংবাদিক’ আইডি বানায় কসমেটিকস!

‘আমি লোকমান, আজ আমার খুব আনন্দের একটি দিন। আমি হলাম দৈনিক স্বাধীন সময় পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। আপনিও হতে পারেন সেই দৈনিক স্বাধীন সময় পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার।’ একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত ভিডিওতে এভাবেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন লোকমান নামে পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি। গত ১২ আগস্ট কথিত পত্রিকার ফেসবুক পোস্ট দিয়ে তিনি এই ঘোষণা দেন এবং ওই ভিডিওর লিংক শেয়ার দেন। ভিডিওতে দেখা যায়, লোকমান এমনকি তাঁর মিডিয়া ও পদের নাম উচ্চারণ করছিলেন অনেক কষ্ট করে। অন্যদিকে রাকিব (ছদ্মনাম) নামের এক ব্যক্তি ফেসবুক স্ট্যাটাসে স্বাধীন সময় নামের ওই পত্রিকায় ‘প্রেস রিপোর্টার’ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। রাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ‘হুজাইফা টয়লেট্রিজ অ্যান্ড কসমেটিকস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ডিলারশিপ নেওয়ার বিনিময়ে সাংবাদিকের আইডি কার্ড পেয়েছেন তিনি। রাকিব স্বীকার করেন, তিনি মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস। এরপর রাজধানীর পুরানা পল্টনের এইচ এম সিদ্দিক ম্যানশনের তৃতীয় তলায় যায় অনুসন্ধানীদল। প্রধান ফটকের দুই পাশে স্বাধীন সময়, হুজাইফা টয়লেট্রিজ অ্যান্ড কসমেটিকসসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। দরজা ঠেলে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছোট্ট রিসেপশন। গাদাগাদি করে বসে আছেন তিন তরুণী। আরেকটি দরজা পেরিয়ে ভেতরে গেলে সরু করিডর। দুই পাশে ছোট ছোট চারটি কক্ষ। তারই একটিতে স্বাধীন সময়ের কার্যালয়। তবে খবর তৈরি নয়, দেখা গেল সাংবাদিক আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে খোলা চা-পাতা প্যাক করছেন কয়েকজন। সেই কক্ষের পাশের একটি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই পাওয়া গেল ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মো. এনামুল হকের ডেস্ক। পরিচয় প্রকাশ না করে দৈনিক স্বাধীন সময়ে চাকরির আগ্রহের কথা বলতেই এনামুল হক বলেন, ‘আপনারা যাঁরা চান এ রকম সৌভাগ্যবান হতে, যাঁদের লেখা জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হবে; তাঁরা স্বাধীন সময় পত্রিকায় যোগ দিতে পারেন। তবে আপাতত স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ঢাকাসহ সারা দেশে সাংবাদিক নিয়োগ দিচ্ছি আমরা। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো প্রয়োজন নেই, স্বশিক্ষিত হলেই চলবে। তবে নিয়োগপ্রাপ্তকে নিউজ পাঠানোর পাশাপাশি বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে হবে। এ ছাড়া নিজের এলাকায় পত্রিকা বিক্রির নিশ্চয়তা দিতে হবে।’ এ সময় কৌশলে হুজাইফার বিভিন্ন পণ্যের ডিলারশিপ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, ‘পণ্যের ডিলারশিপের সঙ্গে সাংবাদিকতার কার্ড নিলে এলাকায় নিজের একটা অবস্থান তৈরি হবে, ক্ষমতাও বাড়বে।’ তবে যে পত্রিকায় নিয়োগের কথা বলছেন এনামুল হক, সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের ২০২১ সালের হালনাগাদ করা নিবন্ধন তালিকায় সেটির নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এনামুল হকের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, তাঁর পত্রিকা সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত। তিনি আরো বলেন, যেকোনো পেশার মানুষ চাইলেই সাংবাদিকতা করতে পারেন—আর এ জন্যই তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান হুজাইফার ডিলারদের নিজের পত্রিকার প্রেস কার্ড দিচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে ঢাকা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রথমে ফোন ও পরে খুদে বার্তা দেওয়া হয়। এরপর ‘স্টাফ অফিসার’ পরিচয়ে একজন কালের কণ্ঠ’র এসিআইসি টিমের সঙ্গে কথা বলেন। জেলা প্রশাসন থেকে ‘স্বাধীন সময়’ নামে কোনো প্রত্রিকার ডিক্লারেশন দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি পত্রিকাটির ছবি ও বিস্তারিত তথ্য চান। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে ছবি ও তথ্য দেওয়া হলে তিনি পরে জানাবেন বলে জানান। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর আবারও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আর কোনো তথ্য দিতে পারবেন না বলে জানান এবং কিছু জানার থাকলে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করার পরামর্শ দেন। এমন নামসর্বস্ব আরো অনেক গণমাধ্যমে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছাড়াই বিভিন্নজনকে সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এসব নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকেই সাংবাদিক পরিচয়ে জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে। গত ৩১ আগস্ট রাতে রাজধানীর উত্তরায় একটি হোটেলে অভিযান চালিয়ে মো. ইকবাল হোসেন (৩১) ও মো. আমিরুল ইসলাম (৩৫) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। অনেক দিন ধরেই বেসরকারি টেলিভিশন ও নামসর্বস্ব পত্রিকার নাম ব্যবহার করে রাজধানীর উত্তরায় চক্রটি তাদের অপরাধ কার্যক্রম চালাচ্ছিল। ২৬ আগস্ট একই এলাকা থেকে ইয়াবাসহ কাজী রিফাতুল মঞ্জুর নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ। ওই যুবক সাংবাদিকতা পরিচয়ের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে উত্তরা এলাকায় মাদক কারবার চালিয়ে আসছিলেন। তাঁর কাছ থেকে ইয়াবা, সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র ও নগদ অর্থও উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাসুদ ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কিছু অনলাইন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, সব দেশেই মাথাব্যথার কারণ। এখানে প্রবণতা আছে অনলাইন পোর্টাল খুলে কিছু মানুষকে কার্ড দেওয়া হয়। প্রথমত, যারা এটি করছে, তারা অনৈতিক কাজ করছে। দ্বিতীয়ত, যারা এসব কার্ড নিচ্ছে, যাদের মূল উদ্দেশ্য সাংবাদিকতা নয়, তাদের দায় সাংবাদিক সমাজের ওপর আসছে। এসব ভুঁইফোড়ের বিষয়ে আমরা ম্যাসিভ অ্যাকশনে যাব।’ এ বিষয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘এই পেশাটা এখন এমন হয়ে গেছে যে সহজেই কেউ একটা পত্রিকার কার্ড বানিয়ে সাংবাদিক হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের অপসাংবাদিকতার কারণে সাংবাদিক সমাজের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে, সাংবাদিকতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের নিবন্ধনের আওতায় আনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা এটা নিয়ে অনেক দিন কাজ করেছি। প্রেস কাউন্সিলে অনেক মিটিং হয়েছে। তবে দ্বিমত থাকায় এখনো ফাইনাল কিছু হয়নি। তবে আমি মনে করি, এটা থাকতে পারে, নিবন্ধনটা থাকা উচিত। তাহলে বোঝা যাবে কারা সত্যিকারের সাংবাদিক, কারা সাংবাদিক না।’ প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ বলেন, ‘সারা দেশেই এখন অপসাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য জেলা প্রসাশন ও ডিএফপিকে সোচ্চার হতে হবে। কোনো গণমাধ্যমের ডিক্লারেশন দেওয়ার সময়ই সেটি সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ নিতে হবে। আর ডিক্লারেশন দিয়ে দায়িত্ব সারলেই হবে না, পরবর্তী সময়েও নজদারিতে রাখতে হবে। কোনো অনিয়ম পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আর ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইন কিংবা আইপি টিভি বন্ধ করতে হবে।’ মফস্বল সাংবাদিকতার চিত্র জানতে যোগাযোগ করা হলে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল প্রেস ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক মো. মাসুম মিয়া বলেন, ‘সিএনজিচালক থেকে ভূমি অফিসের দালালরাও এখন সাংবাদিক। তাদের গলায় শোভা পাচ্ছে সর্বনিম্ন দুটি থেকে পাঁচটি আইডি কার্ড। তারা ৫০ টাকাও চাঁদা নিয়ে থাকে। তাদের জন্য এই মুহূর্তে মূলধারার সাংবাদিকদের সম্মান নিয়ে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে।’ দীর্ঘদিন ধরে মফস্বল সাংবাদিকতা করে আসে নওগাঁর আত্রাই প্রেস ক্লাবের সভাপতি রুহুল আমীন একই উদ্বেগ ব্যক্ত করে বলেন, ‘অনেক সময় জনপ্রতিনিধিরাও কথিত এসব সাংবাদিককে প্রেস ক্লাবের সদস্য করতে তদবির করেন। তাঁদের কারণে বর্তমানে প্রকৃত ও সৎ সাংবাদিকরা কোণঠাসা।’
Link copied!