বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চামড়ায় ভয়ংকর কারসাজি: প্রতি বর্গফুটে ৬৪ টাকা মুনাফা

প্রকাশিত: ০৭:৪৪ এএম, জুলাই ২৯, ২০২১

চামড়ায় ভয়ংকর কারসাজি: প্রতি বর্গফুটে ৬৪ টাকা মুনাফা

একজন মৌসুমি ব্যবসায়ী কুরবানির পশু চামড়ায় (২৫ বর্গফুট) লোকসান গুনছেন সর্বোচ্চ দুইশ টাকা। কেউ ন্যায্য দাম না পেয়ে মাটিতে পুঁতেছেন অথবা রাস্তায় ও নদীতে ফেলে দিয়েছেন। নজিরবিহীন এমন ঘটনা বিগত কয়েক বছর ধরেই ঘটছে। একই আকারের চামড়া আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করে ট্যানারি মালিকরা মুনাফা করছেন প্রায় ১৬শ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বর্গফুটে সব খরচ বাদ দিয়ে আয় করছেন ৬৪ টাকা। আর যে আড়তদার ট্যানারি মালিকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন চামড়া তার পকেটে যাচ্ছে আরও দেড়শ থেকে ২শ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বর্গফুটে আড়তদারের লাভ হচ্ছে আট টাকা। পাইকারদের চামড়া ক্রয় ও প্রক্রিয়াকরণ, ট্যানারির মালিকদের ক্রয় ও মূল্য সংযোজন, জাহাজীকরণসহ অন্যান্য ব্যয় হিসাব-নিকাশ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ), বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই) থেকে এ আয়-ব্যয়ের হিসাব নেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছরে প্রায় ২৭শ কোটি বর্গফুট চামড়া বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ খাতে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ১৭শ কোটি টাকা মুনাফা আসছে চামড়া শিল্পে। কিন্তু এর ৬০ শতাংশ চামড়া সরবরাহ করছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। যাদের অধিকাংশই লোকসান দিচ্ছেন। আর বাংলাদেশে এমন ঘটনা বছরের পর বছর ঘটে আসছে। এটি মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নীরব ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্যমতে, সবচেয়ে বড় কুরবানির পশুর চামড়া (২৫ বর্গফুট আকারের) এ বছর কেনা হয় ৫শ টাকায়। এরসঙ্গে আড়তেই ৭২ শতাংশ অর্থাৎ ৩৬০ টাকা মূল্য সংযোজন হচ্ছে। সেটি হলো একটি চামড়ায় লবণ মেশানোয় ব্যয় ৩শ টাকা। এরমধ্যে ২৫০ টাকার লবণ এবং ৫০ টাকা মজুরি। এছাড়া আড়ত চার্জ ৩৫ টাকা, দাসনদার ১০ টাকা, চামড়া পরিবহণ থেকে নামানো এবং উঠানো (লোড-আন লোড) মজুরি ১৫ টাকা। এসব ব্যয় যোগ হয়ে চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ৮৬০ টাকা। এর সঙ্গে প্রতি পিস চামড়ায় ২০০ টাকা যোগ করে আড়তদারের বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায় ১০৬০ টাকা। এক্ষেত্রে আড়তদারের প্রতি ফুট চামড়ায় মুনাফা হচ্ছে ৮ টাকা। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, প্রতিটি চামড়ায় আমাদের আড়তদারি প্রক্রিয়াগত ব্যয় আছে ৩৬০ টাকা। পাশাপাশি একটি চামড়া থেকে ১শ টাকা থেকে দেড়শ টাকা মুনাফা করতে না পারলে আড়তদাররা এত টাকা বিনিয়োগ করে টিকে থাকতে পারবে না। ফলে ওই হিসাবেই আমরা ট্যানারির মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রি করব। ৫শ টাকায় একটি চামড়া কিনলেও সেটি প্রক্রিয়াজত করে মুনাফাসহ এক হাজার ৫০ টাকা থেকে ১১শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে হবে। বিএফটিআই চামড়া শিল্পে ওপর একটি গবেষণা করেছে। সেখানে দেখানো হয়, একটি ট্যানারিতে চামড়ায় কেমিক্যাল, শ্রমিক, ট্যানারি ভাড়াসহ অন্যান্য খাতে ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় যোগ হচ্ছে। এ ৪৮ শতাংশ মূল্য সংযোগের পরে আড়তদার থেকে ১০৬০ টাকার কেনা চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৬৯ টাকা। পরবর্তী ধাপে জাহাজীকরণসহ অন্যান্য খাতে আরও ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ২৩৫ টাকা ব্যয় রয়েছে। এটি যুক্ত হওয়ার পর ২৫ ফুট আকারের চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৮০৪ টাকা। বিটিএর তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে প্রতি বর্গফুট চামড়ার রপ্তানির মূল্য হচ্ছে ১ দশমিক ৬০ সেন্ট, অর্থাৎ ১৩৫ টাকা। সে হিসাবে ২৫ বর্গফুট আকারের চামড়ার রপ্তানি মূল্য দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪শ টাকা। এ রপ্তানি মূল্য থেকে সব ধরনের প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যয়সহ ট্যানারি চামড়ার ক্রয় মূল্য বাদ দিলে একটি চামড়ায় মুনাফা আসছে ১ হাজার ৫৯৬ টাকা। অর্থাৎ একজন ট্যানারি মালিকের প্রতি বর্গফুট চামড়ায় মুনাফা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৬৪ টাকা। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, বর্তমান বিশ্ববাজারে গ্রেড(এ/বি/সি/ডি) চামড়ার রপ্তানি মূল্য প্রতি বর্গফুট ১ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার। গ্রেড-(ই/এফ/জি/এইচ) হলো ১ দশমিক ২০ মার্কিন ডলার এবং সর্বশেষ গ্রেড (টি/আর) হচ্ছে দশমিক ৪৫ সেন্ট। তিনি আরও বলেন, সরকার লবণযুক্ত চামড়ার যে মূল্য ঘোষণা করেছে ট্যানারির মালিকরা ওই মূল্যেই কেনাকাটা করবে। ওই হিসাবে ট্যানারি মালিকদের এক বর্গফুট চামড়ার ক্রয় মূল্য হবে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এদিকে ঈদের দিন আকার ভেদে পোস্তায় প্রতি পিস গরুর চামড়া আড়ত মালিকরা কিনেছেন ২৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। এর মধ্যে বড় আকারের চামড়া ৫০০ টাকা, মাঝারি ৪০০ টাকা ও ছোট চামড়ার দাম দেওয়া হয় ২৫০ টাকা। রূপগঞ্জ থেকে ট্রাকে করে ৩০০ চামড়া পোস্তায় বিক্রি করতে আসেন মৌসুমি ব্যবসায়ী মো. ফারুক। তিনি বলেন, বিগত এক বছরে সবকিছুর দাম বেড়েছে কিন্তু চামড়ার দাম বাড়েনি। সব চামড়া লোকসান দিয়ে বিক্রি করা হয়। রায়হান নামের একজন মৌসুমি ব্যবসায়ী বলেন, আমি ঢাকার বাইরে থেকে ১৫ লাখ টাকায় আড়াই হাজার পিস চামড়া কিনে এনেছি। কিন্তু চামড়াগুলো বিক্রি করতে পারছি না। কামাল হোসেন নামের মৌসুমি ব্যবসায়ী জানান, রাজধানীর উত্তরা থেকে ২৬০ পিস চামড়া নিয়ে আসেন। চামড়ার যে দাম পাবেন আশা করেছিলেন তা পাচ্ছেন না। প্রতি বছর এভাবে লোকসান দিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের ১ দশমিক ১ শতাংশ অবদান রাখছে চামড়া শিল্প। বিশ্বের মোট চাহিদার দশমিক ৫ শতাংশ পূরণ করা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সাল নাগাদ চামড়া শিল্পের একটি রোড ম্যাপ প্রণয়ন করেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়- এ খাত থেকে বছরে ৩৪৮ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করা হবে। এ জন্য অতিরিক্ত বিনিয়োগের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে ৮ হাজার ৩শ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমান ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি আয় হয়েছে ৯৪ কোটি মার্কিন ডলার। সংশ্লিষ্টদের মতে, চামড়া খাত উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা, মধ্য পর্যায়ের ব্যবস্থাপক ও শ্রমিকদের আরও সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি কাঁচা চামড়া ক্রয়ের ক্ষেত্রে যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। ঈদের আগে মূল্য বেঁধে দেওয়ার পদ্ধতি থেকে বের হয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে হবে।
Link copied!