মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চামড়ায় সেই একই দৃশ্য

প্রকাশিত: ০৭:৫৭ এএম, জুলাই ২৪, ২০২১

চামড়ায় সেই একই দৃশ্য

করোনা মহামারির মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো উদযাপিত হয়েছে পবিত্র ঈদুল আজহা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কোরবানির পশুর চামড়ার ক্রেতা না থাকায় পানির দরে বিক্রি হয়েছে চামড়া। যদিও ঈদের আগে চামড়ার দর নির্ধারণ করে দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এবার বিনা পয়সায় মাদ্রাসা ও এতিমখানার লোকজনকেও চামড়া সংগ্রহ করতে খুব একটা দেখা যায়নি। ঢাকায় মোটামুটি দাম পাওয়া গেলেও রাজধানীর বাইরে সবচেয়ে ভালো মানের কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১০০ টাকায়। আর মাঝারি মানের চামড়া বিক্রি হয়েছে ৫০-৮০ টাকার মধ্যে। কোথাও কোথাও ১৫-২০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে চামড়া। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে নামাজের পর পরই বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় অসংখ্য মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীর ভিড় দেখা গেলেও এবার তাদের দেখা মেলেনি। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৮০ হাজার টাকার গরুর চামড়ার দাম দিচ্ছেন ৮০ টাকারও কম। আর এক লাখ টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দামের পশুর চামড়ার দাম ১৫-২০ টাকা। জানা গেছে, গত বছর কোরবানির ঈদের পর চামড়ার দাম পড়ে যাওয়া নিয়ে দেশে ?হুলস্থূল হয়েছে। এবার গতবারের পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয় সেজন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৫ টাকা করে বাড়িয়ে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু কাঁচা চামড়ার দাম সামান্য বাড়লেও একাধিক সিন্ডিকেট চক্রের হাতেই জিম্মি হয়ে আছে বলে অভিযোগ মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। ফলে এ বছরেও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়েছে। সরজমিনে পুরান ঢাকার পোস্তা ও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের আশেপাশে বেশকিছু আড়তের মোকামের সামনের প্রধান সড়কে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকেও শত শত নষ্ট চামড়া পড়ে থাকতে দেখা গেছে। পরে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা এগুলো বর্জ্য হিসেবে নিয়ে যায়। দাম না পেয়ে দিনভর সংগ্রহ করা কোরবানির পশুর এসব চামড়া ফেলে গেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, আড়তদাররা তাদের কেনা দামও দিতে চাননি। গভীর রাত পর্যন্ত তাদের বসিয়ে রেখে দরদাম চালিয়ে গেলেও শেষ সময়ে ‘পচে যাওয়ার’ অজুহাতে আড়ত বন্ধ করে চলে যান। উপায় না দেখে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যেতে বাধ্য হন। কম দাম কিংবা কৌশলে সময় নষ্ট করে দাম কম দেয়ার প্রস্তাবের অভিযোগ মানতে চাইছেন না আড়তদাররা। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পচা চামড়া এনেছেন বলে দায় এড়াচ্ছেন তারা। এদিকে বৃহস্পতিবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপস ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাস্তার পাশাপাশি অনেক এলাকায় কোরবানির পশুর চামড়া নালা-নর্দমাতেও ফেলে দেয়া হয়েছে। এসব চামড়া নিয়ে করপোরেশনের কর্মীরা বেকায়দায় পড়েছেন। চামড়া ফেলে দেয়া মৌসুমি ব্যবসায়ী বাদল বলেন, বুধবার সারা দিন ৩০০-৫০০ টাকায় গরুর চামড়া সংগ্রহ করে রাত ৮টার দিকে আড়তে বিক্রি করতে নিয়ে আসি। কিন্তু আড়তদাররা গড়ে ৩০০ টাকা করে দাম দিতে চান। এরপর দর কষাকষি করতে করতে সময় নষ্ট হয়, রাত গভীর হয়। পরে আড়তদাররা আমার সংগ্রহ করা চামড়া পচে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে না নিয়ে আড়ত বন্ধ করে চলে যায়। হতাশ হয়ে বলেন, তবুও সারারাত অপেক্ষায় ছিলাম যদি কোনো গতি করা যায়। শেষ পর্যন্ত ভোরে এসব চামড়া আমরা রাস্তায় ফেলে দেই। আমার মতো আরও অনেকেই ছিলেন। তারাও শেষ পর্যন্ত বাড়িতে চলে গেছেন। এলাকাবাসী জানান, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেকেই তাদের সংগ্রহ করা চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। পরে তারা এগুলো রাস্তায় রেখেই চলে যান। পরে এসব চামড়া সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা এসে ময়লা হিসেবে নিয়ে গেছে। আরেক ব্যবসায়ী কাদের জানান, প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা করে কেনা গরুর একেকটি চামড়া তিনি ৫০০-৬০০ টাকায় কিনে এনেছেন। অথচ সেই দামে কিনতে চাচ্ছেন না চামড়া ব্যবসায়ীরা। বলেন, কিছু টাকা ধার নিয়ে চামড়া কিনেছি লাভের আশায়। কিন্তু কেনা দামে বিক্রি করতে পারছি না। তবে দাম না পেয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের রাস্তায় চামড়া ফেলে চলে যাওয়ার ঘটনা অস্বীকার করেন পোস্তার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের মহাসচিব হাজি টিপু সুলতান। তিনি বলেন, আমরা যথারীতি সরকারের বেঁধে দেয়া দামে, অনেক ক্ষেত্রে সেই দামের চেয়েও বেশি দামে চামড়া কিনে নিয়েছি। সবচেয়ে ছোট গরুর চামড়া ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে বড় চামড়া ৯০০ টাকা পর্যন্ত কিনেছি। তবে আমরা তো পচা চামড়া কিনবো না। অন্যদিকে করোনার কারণে এবার মাদ্রাসা থেকেও শিক্ষার্থীদের কোরবানির পশুর চামড়া কেনার জন্য পাড়া-মহল্লায় দেখা যায়নি। কয়েক বছর আগেও যে চামড়া বিক্রি হতো ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায়। এবার সেই একই ধরনের চামড়ার দাম ১০০ থেকে ২০০ টাকা। ফলে গত দুই-তিন বছরের মতো এবারও কোরবানির পশুর চামড়ায় যাদের হক রয়েছে, সেই এতিম ও দুস্থরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া সাধারণ ব্যবসায়ীরাও পড়ছেন আর্থিক ক্ষতির মুখে। এবার সরকার গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম বর্গফুটপ্রতি ৫ টাকা করে বাড়িয়ে ঢাকায় ৪০-৪৫ টাকা আর ঢাকার বাইরে ৩৩-৩৭ টাকা করেছে। আর ছাগলের চামড়ার দাম ঠিক করা হয় বর্গফুটপ্রতি ১২-১৭ টাকা। অথচ নির্ধারিত দামের আশেপাশেও থাকছেন না ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি বড় গরু থেকে ৪৫ বর্গফুট পর্যন্ত চামড়া পাওয়া যায়, ছোট গরুতে পাওয়া যায় ২০ বর্গফুট। সর্বনিম্ন ৪০ টাকা দর হিসাব করলে বড় গরুর লবণযুক্ত চামড়া ১ হাজার ৮০০ টাকা ও ছোট গরুর চামড়া ৮০০ টাকায় ট্যানারিগুলো কেনার কথা ছিল। এই হিসাবে লবণের দাম, অন্যান্য খরচ ও আড়তদারদের মুনাফা বাদ দিলে প্রতিটি লবণযুক্ত চামড়ার দাম ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পাওয়ার কথা ছিল বিক্রেতাদের। কিন্তু ছোট-বড় সব গরু মিলিয়ে রাজধানীর চামড়া বিক্রেতারা ২৫০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যেই চামড়া বিক্রি করেছেন। ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, দাম না পেয়ে চামড়া ফেলে দেয়া হয়েছে এই কথাটির সঙ্গে আমি একমত না। মূলত কিছু জায়গায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ না করায় সেগুলো পচে যাওয়ায় ফেলে দেয়া হয়েছে। এটা তাদের ভুলের কারণেই হয়েছে। কারণ পচা চামড়া তো কেউ কিনবে না। অন্যদিকে আবার লবণের সংকট তৈরি করা হয়েছে। ৫৫০ টাকার যে লবণ সেটি এবার ৮০০-৯০০ টাকা বস্তা বিক্রি করা হয়েছে। তবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একেবারে পানির দামে চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে। ন্যায্য মূল্য না পেয়ে কেউ কেউ চামড়া ফেলে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর পেছনে আড়তদারদের কারসাজি থাকতে পারে। এদিকে বগুড়াসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় গরিবের হক কোরবানির পশু গরু, ছাগল ও ভেড়ার চামড়া রাস্তার পাশে ফেলে দেয়া হয়েছে। চাহিদামতো সংগ্রহ করতে না পেরে ও লোকসানের ভয়ে অনেক সাধারণ ব্যবসায়ী ঈদের পরদিন শহরের রাস্তার পাশে চামড়া ফেলে দেন। ফেলে দেয়া এসব চামড়া পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা জানিয়েছেন, ফেলে দেয়া অন্তত ১৪ হাজার চামড়ার মধ্যে ছাগলের চামড়া ও গরুর মাথার চামড়াই বেশি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কোরবানির জন্য গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়াসহ পশুর চাহিদা রয়েছে ৯৫ লাখ থেকে ১ কোটি ১০ লাখ। চলতি বছর দেশে কোরবানির যোগ্য পশু রয়েছে ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার। গত বছর করোনার কারণে বাংলাদেশে ১ কোটির কিছু বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। ট্যানার্স এসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এদিকে গত ২০শে জুলাই পর্যন্ত ডিজিটাল হাটে সারা দেশে মোট পশু বিক্রি হয়েছে, ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৪২৮টি পশু। এর মধ্যে গরু ও মহিষ ২ লাখ ৬৭ হাজার ৫৬৬টি। আর ছাগল ও ভেড়া ৮১ হাজার ৮২২টি। পশুগুলোর দাম দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪২৪ কোটি ৯ লাখ ৩৬ হাজার ২৫৪ টাকা।
Link copied!