মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চালানের পণ্য জাহাজেই ওঠেনি, নথিতে রফতানি সম্পন্ন

প্রকাশিত: ০১:১২ পিএম, ডিসেম্বর ২, ২০২১

চালানের পণ্য জাহাজেই ওঠেনি, নথিতে রফতানি সম্পন্ন

সংশ্লিষ্ট নথি ও রেকর্ড বলছে, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে দুবাই, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবে আলু ও তিল বীজ রফতানি করেছে জান্নাত করপোরেশন ও সিয়াম ইন্টারন্যাশনাল নামে ঢাকার দুই প্রতিষ্ঠান। যদিও বাস্তবে বন্দরের অফডক থেকে এ দুই প্রতিষ্ঠানের এমন কোনো পণ্যের চালান জাহাজীকরণের কোনো প্রমাণই পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি এমন জালিয়াতি ধরা পড়ার পর বিষয়টি নিয়ে গভীর অনুসন্ধানে নেমেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কর্মরত নেই, এমন দুই রাজস্ব কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে এ জালিয়াতি ঘটিয়েছে অভিযুক্তরা। ধারণা করা হচ্ছে, কৃষিপণ্য রফতানিতে সরকারের দেয়া নগদ সহায়তা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে এমন নয়টি রফতানি চালানের ভুয়া রেকর্ড তৈরি করা হয়েছে। বিষয়টি ধরা পড়ার পর বর্তমানে চালানগুলোর বিপরীতে নথি চেয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে চিঠি পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে ভুয়া রফতানির বিপরীতে সরকারের নগদ সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা, তা-ও জানতে চাওয়া হবে। কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, রফতানি জালিয়াতিতে অভিযুক্ত দুই প্রতিষ্ঠান ঢাকার জান্নাত করপোরেশন ও সিয়াম ইন্টারন্যাশনালের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হিসেবে চট্টগ্রামের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। এগুলো হলো প্যান বেঙ্গল এজেন্সি লিমিটেড, বেঙ্গল প্রগ্রেসিভ এন্টারপ্রাইজ, এঅ্যান্ডজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, কেআরএস সিঅ্যান্ডএফ লিমিটেড ও জিআর ট্রেডিং করপোরেশন সিঅ্যান্ডএফ লিমিটেড। চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মো. ফখরুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, পণ্য রফতানি কার্যক্রমে বেশ কয়েকটি চালানে জালিয়াতি উদ্ঘাটনের পর এখন তদন্ত চলছে। এ ধরনের জালিয়াতি রোধে কাস্টমসের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সিঅ্যান্ডএফ ছাড়াও আমাদের কর্মকর্তাদের কোনো অনিয়ম বা অবহেলা রয়েছে কিনা, তা-ও সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হবে। কাস্টমস নথি অনুযায়ী, এনবিআরের সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে দুবাইয়ে ৫১ হাজার ৪৩০ ডলারের ১৮৭ টন আলু রফতানির তথ্য বসানো হয়েছে জান্নাত করপোরেশনের (বিআইএন নম্বর: ০০১৩৪২০৭৫)। এজন্য এলসি খোলা হয়েছে উত্তরা ব্যাংক লিমিটেডে (নম্বর : জেসি/ইউবি/এফপি/১৭-২০২০)। নথি অনুযায়ী চট্টগ্রামের এসএপিএল অফডক থেকে ১৮ হাজার ৫০০ প্যাক আলু চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠিয়ে জাহাজে করে যাওয়ার কথা দুবাইয়ের ৩১৬, আয়াল নাসর বিল্ডিং, নাইফ রোড (পিও বক্স ১৭১৭৫৬) ঠিকানার আমদানিকারক মডার্ন লোটাস জেনারেল ট্রেডিং এলএলসির কাছে। রফতানি কার্যক্রমে দেশের রফতানিকারকের পক্ষে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছে চট্টগ্রামের ১৭২ আনন্দ মার্কেট খাতুনগঞ্জ ঠিকানার প্যান বেঙ্গল এজেন্সি লিমিটেড। একই রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালয়েশিয়ায় রফতানি দেখানো হয়েছে ৫০ হাজার ৫৪০ ডলার মূল্যের ১৮২ টন আলু। এ-সংক্রান্ত এলসি খোলা হয়েছে উত্তরা ব্যাংক লিমিটেডে (নম্বর : জেসি/ইউবি/এফপি/২৪/২০২০)। এক্ষেত্রে ওসিসিএল অফডক থেকে ৭ হাজার ২২০টি প্যাকেটে করে আলু চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে জাহাজে তুলে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে পাঠানোর তথ্য দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ রয়েছে চট্টগ্রামের ১৬৮ সদরঘাট রোড ঠিকানার বেঙ্গল প্রগ্রেসিভ এন্টারপ্রাইজ। ৩৮ হাজার ৩৬৪ ডলার মূল্যের ১৩৯ টন আলু রফতানির একটি এলসি খোলা হয়েছে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডে (এলসি নম্বর : জেসি/বিএ/এফপি/০১/২০২০)। এছাড়া উত্তরা ব্যাংকে ৪৮ হাজার ৭২০ ডলারের ১৭৬ টন (এলসি নম্বর : জেসি/ইউবি/এফপি/২২/২০২০), ৫০ হাজার ৪০ ডলারের ১৮১ টন (এলসি নম্বর : জেসি/ইউবি/এটিএফ/০৩-২০২১) ও ৪৮ হাজার ৬৫০ ডলারের ১৭৬ টন (এলসি নম্বর : জেসি/ইউবি/এফপি/১৬-২০২১) ও ৫০ হাজার ৪০ ডলারের ১৮১ টন (এলসি নম্বর : জেসি/ইউবি/এফবি/১৭-২০২০) আলু রফতানির এলসি খোলার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে । অভিযুক্ত আরেক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান সিয়াম ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সৌদি আরবে ৪৫ হাজার ডলার মূল্যের ২৮ হাজার কেজি বাদামি তিল বীজ রফতানির ভুয়া তথ্য রেকর্ড তৈরির অভিযোগ উঠেছে। উত্তরা ব্যাংক লিমিটেডে এ-সংক্রান্ত এলসি খোলার তথ্য দেয়া হয়েছে (নম্বর : সিয়াম/ইউবি/এফপি/২০/০১)। ইএএলএল অফডক থেকে সৌদি আরবে ১ হাজার প্যাকেটে তিল বীজ পাঠানোর ভুয়া আরেকটি রফতানি চালানের সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নাম রয়েছে চট্টগ্রামের ১০২ আগ্রাবাদ ঠিকানার জিআর ট্রেডিং করপোরেশন সিঅ্যান্ডএফ লিমিটেডের। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটি আরেক চালানের মাধ্যমে ৪৭ হাজার ৫০০ ডলারের ২৫ হাজার ৮০০ কেজি বাদামি তিল বীজ দুবাইয়ে রফতানির তথ্য দিয়েছে। উত্তরা ব্যাংক লিমিটেডে খোলা এ-সংক্রান্ত এলসির নম্বর : সিয়াম ইউএই বিএসএস ২০০২। এ বিষয়ে রফতানিকারক জান্নাত করপোরেশনের মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্যান বেঙ্গল এজেন্সিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, গত বছর অসুস্থ থাকার কারণে একজনকে অস্থায়ীভাবে কাজ করার জন্য আমার প্রতিষ্ঠানের পাসওয়ার্ড দিয়েছিলাম। এটা পেপার রেডি করার জন্য দিতে হয়েছিল। কিন্তু পরে মনে করে আর পরিবর্তন করতে পারিনি। রফতানিতে জালিয়াতির এ ঘটনায় এখন বড় ধরনের অস্বস্তিতে আছি। এ ধরনের জালিয়াতিতে একটি বড় চক্র গড়ে উঠেছে। আমরাও চাই কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অ্যাকশনে যাক। আরেক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল প্রগ্রেসিভ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারি মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জালিয়াতির এ প্রক্রিয়ায় আমার প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এলেও আমি এ বিষয়ে অবগত নই। রফতানি জালিয়াতিতে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান সিয়াম ইন্টারন্যাশনালের মনোনীত প্রতিনিধি জিআর ট্রেডিং করপোরেশন সিঅ্যান্ডএফ লিমিটেডের পরিচালক রাশিদা পারভিন বলেন, আমাদের লাইসেন্স ব্যবহার করে আমাদের আত্মীয় ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। কার্যক্রমে যুক্ত না থাকায় আসলে এ ঘটনায় কোনো কিছুই অবগত ছিলাম না। এ ধরনের রফতানি জালিয়াতির পদ্ধতি সম্পর্কে কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রথমে রফতানিকারকের পক্ষ থেকে বিল অব এক্সপোর্ট দাখিল করে অপেক্ষা করা হয়। এরপর প্রতারক চক্র কাস্টমস কর্মকর্তাদের সার্ভারে প্রবেশে প্রয়োজনীয় আইডি-পাসওয়ার্ড জোগাড়ের জন্য হন্যে হয়ে ওঠে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ফাঁকি দিয়ে বা যোগসাজশে জোগাড় হওয়া রাজস্ব কর্মকর্তার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে সিস্টেমে অনুপ্রবেশ করে প্রতারকরা। এর বাইরে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে যে সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে ভিন্ন কোনো উপায়ে প্রবেশের সুযোগ নেই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, বন্দর ও কাস্টমসের ডিজিটালাইজেশন আমরা ইতিবাচকভাবে দেখতে চেয়েছিলাম। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা ভালো উদ্যোগ কীভাবে বিনষ্ট করা যায়। এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, শুধু তাদের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে হবে না। যাদের যোগসাজশে অর্থাৎ যেসব সরকারি কর্মকর্তা অনৈতিক পন্থায় এ ধরনের জালিয়াতির সুযোগ করে দিয়েছে, তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নগদ সহায়তা হলো রফতানিকারকদের জন্য এক ধরনের বিশেষ প্রণোদনা। বর্তমানে ৪২টি পণ্য রফতানিতে ১ থেকে ২০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। জনগণের করের টাকায় জাতীয় বাজেট থেকে এ খাতের জন্য প্রতি বছর বড় অংকের বরাদ্দ থাকছে। বছর বছর এ বাবদ সরকারের ব্যয়ও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে নগদ সহায়তার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ নগদ সহায়তা পেতে রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকের কাছে রফতানির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নথি হিসেবে বিল অব এক্সপোর্ট, বিল অব লেডিং, রফতানি ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট ইত্যাদি জমা দিতে হয়। সম্প্রতি নগদ সহায়তা নিয়ে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয়ের অধীন সিভিল অডিট অধিদপ্তরের ২০২১ সালের অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্টে (এআইআর) ১০টি ব্যাংকের ৩৭টি শাখায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে চামড়া, কৃষি, পাট, বস্ত্র, প্রাণিজ সম্পদ, হিমায়িত মত্স্য এমনকি গরুর নাড়িভুঁড়ি রফতানিতেও জালিয়াতি ও কারসাজি করে ৭৫০ কোটি টাকা তুলে নেয়ার তথ্য উঠে এসেছে। কর ও ভ্যাট ফাঁকি সংক্রান্ত অনিয়ম হয়েছে ৮৫০ কোটি টাকার। পদ্ধতিগত অনিয়ম হয়েছে ৯০০ কোটি টাকার। ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত চার অর্থবছরের নগদ সহায়তার ওপর প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র যাচাই এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে সিভিল অধিদপ্তরের নিরীক্ষা দল। সূত্র: বণিক বার্তা
Link copied!