বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

টাকা থাকলে জেলেও মুক্ত জীবন

প্রকাশিত: ০১:০১ পিএম, নভেম্বর ২৮, ২০২২

টাকা থাকলে জেলেও মুক্ত জীবন

মোবাইলে কথোপকথনের প্রায় ১০ মিনিটের একটি অডিও রেকর্ড। এক প্রান্ত থেকে একজন কার কার বাসায় ডাকাতি করা যাবে সেসব নির্দেশনা দিচ্ছেন। ফিসফিসিয়ে কথা বলছেন তিনি। অন্য প্রান্তে থাকা ব্যক্তি সেসব নির্দেশনা শুনে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে সম্মতিসূচক আলাপচারিতাও চলছে। এটি আড়িপাতা কোনো অডিও রেকর্ড নয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডাকাত সন্দেহে কয়েক যুবককে গ্রেপ্তারের পর তাদের এক সহযোগীর মোবাইলে এই অডিও রেকর্ড পাওয়া যায়। ওই ডাকাত দল সাধারণ কেউ নয়, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য। আর যে দুজন কথা বলেছেন, তার একজন জঙ্গি সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম হৃদয়। অন্যজন কাশিমপুর হাই-সিকিউরিটি কারাগারে থাকা আরেক জঙ্গি আল-আমিন। পরে আল-আমিনকেও ওই ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে আনা হয়। জেল থেকেই মোবাইল ফোন ব্যবহার ও ডাকাতির নির্দেশনা দেয়ার কথা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন আল-আমিন। শুধু মোবাইল ফোনই নয়, কারাগারে টাকা দিলে সবই মেলে। উন্নত জীবনযাপনের প্রায় সব ধরনের সুবিধাই পাওয়া যায় সেখানে। মোবাইলে কথোপকথন, ইন্টারনেট ব্যবহার, ভালো খাবার কিংবা মাদক- সবই হাতের নাগালে। গত বছরের প্রথম দিকে কারাগারে থাকা অবস্থায় হল-মার্কের কর্মকর্তা তুষারের নারীসঙ্গের একটি ঘটনাও ফাঁস হওয়ার পর তোলপাড় হয়েছিল। জেল থেকে আদালতে আনা-নেয়ার মধ্যবর্তী সময়ে নিজ বাসায় স্ত্রীর সঙ্গে একান্ত সময় কাটানোর তথ্যও রয়েছে। দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ও কাইল্যা পলাশ আদালতে আনা-নেয়ার সময় নিজ বাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি কারাগার থেকে আদালতে ১২ জঙ্গিকে হাজির করার পর শুনানি শেষে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় কারাগারের ভেতর দুর্নীতি ও বাণিজ্যের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারাগারের ভেতরটি পুরোপুরি দুর্নীতি আর অনিয়মে ভরা। যার টাকা আছে, কারাগারে তার কোনো সমস্যা হয় না। একমাত্র বাইরে মুক্ত বাতাসে ঘোরাঘুরি ছাড়া বাকি সবই পাওয়া যায় টাকার বিনিময়ে। একশ্রেণির অসাধু কারা কর্মকর্তা ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা মিলে একেকটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছে দেশের বিভিন্ন কারাগারের ভেতর। এই সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করে কারাগারের সবকিছু। সম্প্রতি আবু জাফর বিপ্লব নামে ডাকাতি মামলার এক আসামির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। আবু জাফর জানান, কারাগারে তিনি ভাত বিক্রি করে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন। আদালতে হাজির করার সময় সেই টাকা উকিলকে দিয়ে জামিনে বের হয়ে এসেছেন। কীভাবে এটি সম্ভব- এই প্রশ্নের উত্তরে বিপ্লব জানান, কারাগারে যেসব খাবার দেয়া হয়, সেসব অত্যন্ত নিম্নমানের। নতুন বন্দিদের অনেকই তা খেতে পারে না। কিন্তু যারা কারাগারের পুরোনো বন্দি বা কাজ করে তারা ভালো খাবার খায়। এক কারারক্ষীকে ঘুষ দিয়ে তিনি ভালো চাল রান্না করে ভাত বিক্রি করতেন। এতে সপ্তাহে তার ৪ হাজার টাকা আয় হতো। এর মধ্যে ১ হাজার টাকা সেই কারারক্ষীকে দিতে হতো। এভাবেই তিনি কয়েক মাসে ৩০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। আবু জাফর বিপ্লব বলেন, ‘আদালতে হাজিরার দিন অত বেশি তল্লাশি হয় না। তখন টাকা নিয়ে বের হওয়া যায়। আদালতে শুনানির সময় সেই টাকা উকিলকে দিয়ে জামিনে বের হয়েছি।’ গত কয়েক মাসে বিভিন্ন মামলায় সাময়িক সময়ের জন্য জেল খাটা বেশ কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের সবার ভাষ্য, টাকা দিলে সবই পাওয়া যায় কারাগারে। নিজের অভিজ্ঞতার বিশদ বর্ণনা দিয়ে পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা এক যুবক জানান, একটি মামলায় তিনি প্রায় তিন মাস ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারাগারে প্রবেশের পর পরই শুরু হয় অবৈধ বাণিজ্য। কোন ওয়ার্ডে থাকবেন তার ওপর ভিত্তি করে টাকা লেনদেন শুরু হয়। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, গভর্নমেন্ট ওয়ার্ড নাকি মক্কেল ওয়ার্ডে থাকবেন। গভর্নমেন্ট ওয়ার্ড হলো সাধারণ যেখানে এক কক্ষে থাকতে হয় ৩০-৪০ জন। আর মক্কেল ওয়ার্ডে তুলনামূলক কম লোকজন থাকে। এ জন্য কারাগারে ঢুকেই তিনি চিফ রাইটারকে ২ হাজার টাকা দেন। সে সময় চিফ রাইটার ছিলেন বিডিআর মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি পঞ্চগড়ের বাসিন্দা আরিফ। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জেলে ঢোকার পর পরই আমদানি রুমে নেয়ার পরই ওয়ার্ড বাণিজ্য শুরু হয়। মক্কেল ওয়ার্ড বা গভর্নমেন্ট ওয়ার্ডে যাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই হাসপাতালে থাকতে চান। হাসপাতালে থাকতে হলে প্রথমে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। পরবর্তী সময়ে প্রতি সপ্তাহে দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। প্রতিটি কারাগারেই একটি করে হাসপাতাল আছে। সেখানে থাকতে বন্দিদের খরচ করতে হয় বেশি। দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের এনফোর্সমেন্ট শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, তারা ২০১৯ সালে একবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অভিযান চালিয়েছিলেন। অভিযানের সময় সঙ্গে একজন চিকিৎসকও নিয়ে যান তারা। কোনো ধরনের অসুস্থতা না থাকলেও কারা হাসপাতালে টাকার বিনিময়ে থাকা অনেককেই তখন চিহ্নিত করেছিলেন তারা। দুদকের ওই কর্মকর্তা বলেন, কারাগারের ভেতর দুর্নীতির মহাযজ্ঞ চলে। কিন্তু অভিযান করা যায় না। কারণ ভেতরে অভিযান চালাতে তিন-চারটি গেট পার হতে হয়। গেট থেকে ভেতরে ঢুকতেই সময় লেগে যায় অন্তত আধা ঘণ্টা। এর মধ্যে খবর পেয়ে সবাই সতর্ক হয়ে যায়। কারা সূত্র জানায়, কারাগারগুলোতে কয়েক দিন পর পরই বন্দিদের ভিন্ন ভিন্ন কারাগারে পাঠানোর একটি তালিকা তৈরি করা হয়। এই বন্দি স্থানান্তরের নামেও চলে বাণিজ্য। বিশেষ করে কোনো বন্দি একটি কারাগারে থাকায় তার বন্ধু তৈরি হয় বা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য নেপথ্যের ব্যক্তিদের সঙ্গেও পরিচয় হয়। অন্য কারাগারে স্থানান্তর করা হলে সেসবে বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে বন্দিরা স্থানান্তরের চালান বাতিল করতে চান। প্রতিটি স্থানান্তরের চালান বাতিল করতে চিফ রাইটারকে দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। খাবারের বাণিজ্য সবচেয়ে বেশি কারাবন্দী ও কারগারের একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে ভালো থাকার ব্যবস্থা ছাড়াও খাবার নিয়ে বাণিজ্য হয় সবচেয়ে বেশি। জেলকোড অনুযায়ী বন্দিরা সকাল, দুপুর ও রাতে নির্দিষ্ট খাবার পান। সকালে রুটি, পাউরুটি, চিনি, গুড়, ডাল, দুধ, জেলি, ঘি, মাখন, কলা ও চা। দুপুরের খাবারের তালিকায় রয়েছে ভাত কিংবা রুটি, মাছ বা মাংস, শাকসবজি ও ডাল। রাতের খাবারে ভাত কিংবা রুটি, মাছ বা মাংস, শাকসবজি ও ডাল। কিন্তু বাস্তবে সকালে একটি রুটি ও গুড়, দুপুর ও রাতে ভাতের সঙ্গে পাঁচমিশালি সবজি ও ডাল দেয়া হয়। বরাদ্দ অনুযায়ী মাছ-মাংস দেয়ার কথা থাকলেও তা এত নগণ্য যে বেশির ভাগ সময় তা পাওয়া যায় না। তবে টাকা খরচ করলে উন্নত খাবার পাওয়া সম্ভব। জানা গেছে, কারাগারের ভেতর এক কেজি গরুর মাংস রান্না করে বিক্রি করা হয় ২ থেকে ৩ হাজার টাকায়। ভালো চালের কেজি বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। এক কেজি আলু বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। একটি ফুলকপি ২০০ টাকা। একটি রাজহাঁস ৪ হাজার টাকা। ছোট হাঁস ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। প্রত্যেকটি খাবারের উপকরণের দাম অন্তত ৮ থেকে ১০ গুণ বাড়িয়ে নেয়া হয়। পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন কারাগারগুলোর চিফ রাইটাররা। দণ্ডপ্রাপ্ত বা বহুদিন ধরে জেল খাটছেন এমন কয়েদিদের দিয়ে পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন জেল সুপার বা জেলাররা। কয়েদিকে চিফ রাইটার হওয়ার জন্য ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা ঘুষও দিতে হয়। মোবাইল ফোন ব্যবহারই মূল মাথাব্যথা কারাগারের ভেতর বাটন ফোনের পাশাপাশি স্মার্টফোনের ব্যবহারও চলে হরদম। সর্বশেষ দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়েও কারাগারের ভেতর তাদের মোবাইল ব্যবহারের তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। কারা সূত্র জানায়, কারাগারে সরকারিভাবে মোবাইল ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে। একজন বন্দি সপ্তাহে এক দিন ১০ টাকা দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট কথা বলতে পারবেন। কিন্তু অবৈধভাবে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত রীতিমতো লাইন ধরে মোবাইল ফোনে কথা বলার ব্যবস্থা রয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা এই ব্যবসা করেন। অবৈধভাবে কারাগারগুলোতে প্রতি ৩ মিনিট কথা বলতে ১০০ টাকা দিতে হয়। সারা রাত মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করলে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। রাজনৈতিক নেতা, শীর্ষ সন্ত্রাসী বা ধনী বন্দিরা নিয়মিত স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, কারাগারে শীর্ষ সন্ত্রাসী বা জঙ্গিদের মোবাইল ফোন ব্যবহার ওপেন সিক্রেটের মতো। একজন শীর্ষ জঙ্গি ল্যাপটপ ব্যবহার করত বলেও তাদের কাছে তথ্য ছিল। কারা অভ্যন্তরে যেভাবে যায় মোবাইল ও মাদক বন্দিদের কেউ কেউ একেবারে ছোট্ট বা আঙুলের মতো দেখায় এ রকম চীনের তৈরি মোবাইল সেট পায়ুপথের মাধ্যমে নিয়ে যায়। এ ছাড়া দিনের বেলা কারাগারের ভেতরের সীমানাপ্রাচীরের দিকে দায়িত্বরত কারারক্ষীদের ম্যানেজ করে বাইরে থেকে স্কচটেপ পেঁচিয়ে ঢিল মেরে মোবাইল ভেতরে ফেলা হয়। একই কায়দায় কারাগারে গাঁজা, ইয়াবা এবং হেরোইনের মতো মাদকও ঢোকে। টিভি দেখার বিনিময়েও হয় বাণিজ্য আগে কারাগারে বন্দিদের বিপুল অর্থের বিনিময়ে অবৈধভাবে টেলিভিশন দেখার ব্যবস্থা থাকলেও গত বছর কারা কর্তৃপক্ষ বন্দিদের বিনোদনের জন্য সব ওয়ার্ডে টেলিভিশন দেয়ার অনুমোদন দেয়। কারাগারের ভেতরের ক্যান্টিনের লাভের টাকা থেকে টেলিভিশন কেনার জন্য কারা সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু সেই টেলিভিশন নিয়েও চলে বাণিজ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারাগারের ভেতর গভর্নমেন্ট ওয়ার্ড হিসেবে যেগুলো পরিচিত, সেগুলোতে কোনো টেলিভিশন দেয়া হয় না। টিভি লাগানো হয় মক্কেল ওয়ার্ড বলে পরিচিত ওয়ার্ডগুলোতে। আবার সাধারণ টেলিভিশনের পরিবর্তে অর্থের বিনিময়ে স্মার্ট টেলিভিশনের ব্যবস্থাও রয়েছে। এসব টিভিতে পেনড্রাইভের মাধ্যমে বিভিন্ন মুভি বা গান বাজানো হয়। পেনড্রাইভে গান বা মুভি দেয়ার বিনিময়েও নেয়া হয় অর্থ। মন্তব্য নেই কারা কর্তৃপক্ষের কারাগারের অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা রকম অবৈধ বাণিজ্যের বিষয়ে মন্তব্য জানতে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হক ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগ ও খুদেবার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা স্বীকার করেন, ঢাকা ও কাশিমপুরের চারটি কেন্দ্রীয় কারাগার, সিলেট ও চট্টগ্রাম কারাগারে অনিয়মটা হয়। অন্যান্য জেলা কারাগার থেকে তেমন বড় অভিযোগ আসে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) হাবিবুর রহমান নানা অনিয়ম প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা তো কেবল সুপারিশ করতে পারি। কারা প্রশাসন চালায় আইজি প্রিজন্স। আমরা বিভিন্ন সময়ে কারাগারে শুদ্ধি অভিযানের জন্য সুপারিশগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।’
Link copied!