বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ট্যাক্স কি যানজট কমাবে

প্রকাশিত: ০৫:৩২ পিএম, অক্টোবর ১৭, ২০২১

ট্যাক্স কি যানজট কমাবে

রাজধানীর রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। এ জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হচ্ছে প্রাইভেট কার বা ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারের ব্যাপকতাকে। তাই যানজট কমাতে অভিজাত এলাকার সড়কগুলোতে এসব গাড়ি প্রবেশ করলে ট্যাক্স নেওয়ার চিন্তা করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। যদিও এ ভাবনা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। নগরবিদরা ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলামের এই ভাবনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সর্বপ্রথম করণীয় হলো, যানজট ফি নেওয়া, যে আইন ও নিয়ম বর্তমানে রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ, গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহিত করা, ফুটপাথ দখলমুক্ত করা, ছোট গাড়ির লাইসেন্স কম দেওয়া, এক পরিবারে একটার বেশি গাড়ি না দেওয়া, আমলাদের গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং পার্কিংয়ের ফি বৃদ্ধি করা। সম্প্রতি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় প্রাইভেট কার চালালে ট্যাক্স লাগবে। মেশিন বসিয়ে প্রথমে গাড়ি গণনা করা হবে। দেখব কত গাড়ি প্রবেশ করে। তারপর একটি সমীক্ষা করে বিষয়টি কার্যকর করব।’ তবে মেয়র শুধু প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করার কথা বললেও উন্নত দেশগুলোতে যানজটপ্রবণ এলাকার সড়ক ব্যবহার করলে সব গাড়িতেই ফি নেওয়া হয়। যেমন সিঙ্গাপুরে ইআরপি সিস্টেমের মাধ্যমে কনজেশন প্রাইজিং ফি নেওয়া হয়। তারা ১৯৯৮ সাল থেকে ইআরপি সিস্টেম ব্যবহার করছে। ফলে ফি নেওয়া বিশ্বের সব শহরেই যানজট কমেছে। একই সঙ্গে যে টাকা আয় হয়, তার বেশির ভাগই ওই সব শহর ও সড়ক উন্নয়নের কাজে খরচ করা হয়। ইলেকট্রনিক্স রোড প্রাইজিং (ইআরপি) সিস্টেম সিঙ্গাপুর শহরের প্রতিটি রাস্তার এই প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে। নির্দেশনা দেওয়া আছে, নির্দিষ্ট ওই সড়ক পার হওয়ার পরই চার্জ করা হবে। আর গাড়িগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য সব গাড়িতেই বিশেষ নম্বর প্লেট ব্যবহার করা হয়েছে। যখন ইআরপি এলাকায় প্রবেশ করে তখন সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নম্বর প্লেট শনাক্ত করা হয়। এরপর শনাক্ত করা ওই নম্বর প্লেটের গাড়ির মালিককে টাকা গুনতে হয়। এ জন্য ডেবিট কার্ডের মতো একটি কার্ড সবাইকে বাধ্যতামূলক নিতে হয়। আর এই ফি বা মাশুল একেক সময় একেক রকম হয়ে থাকে। যেমন পিক আওয়ার বা ব্যস্ত সময়ে যদি ১৫ সিঙ্গাপুর ডলার হয় তা হলে ফাঁকা সময়ে তা নেমে আসে ২ ডলারে। অন্যদিকে ওই নির্দিষ্ট এলাকা পার হওয়ার পর কোনো চালকের কার্ডে যদি ডলার না থাকে তা হলে ১০ ডলার জরিমানা করা হয়। এরপরও যদি কার্ডে ফি না দেওয়া হয় তা হলে রেজিস্টার গাড়ির মালিককে ৭০ ডলার জরিমানা করা হয়। যদি ৩০ দিনের মধ্যে এই ফিও না দেওয়া হয় তা হলে ১ হাজার ডলার জরিমানা অথবা এক মাসের জেল দেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরের এই পদ্ধতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহর ও সুইডেনের স্টকহোম শহর কর্তৃপক্ষ একইভাবে কনজেশন প্রাইজিং (যানজট মাশুল) আদায় করে। লন্ডন: রাস্তার যেখান থেকে যানজট ফি দিতে হয় সেখানের শুরুতে ইংরেজি সি অক্ষর দিয়ে সাইনবোর্ড লাগানো আছে। সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কনজেশন প্রাইজিং চালু রাখা হয়। এর ফলে যানজট যেমন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি শব্দ দূষণও কমেছে। এই সময়ের মধ্যে চলাচল করলে বর্তমানে ১১ দশমিক ৫০ ইউরো থেকে ১৫ ইউরো ফি দিতে হয়। সেখানেও অটোমেটিক নম্বর প্লেট রিকগনিশন (এএনপিআর) বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ির নম্বর প্লেট জানা যায়। তবে কিছু সময় সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্তও এই ফি নেওয়া হয়। ২০০৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ২৬ কোটি ইউরো আয় হয়। এর মধ্যে ১২ কোটি ইউরো শহর কর্তৃপক্ষ ব্যয় করে পথচারী-সাইকেলের রাস্তা, রোড-ব্রিজ ও গণপরিবহনের উন্নয়নে। স্টকহোম: সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমেও এই পদ্ধতিতে ফি আদায় করা হয়। তবে তাদের মাস শেষে ওই বিল দিতে হয়। এ ছাড়া ফি নেওয়ার সময় নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ফি নেওয়া হয়। এই ফি ১ দশমিক ৬২ ইউরো থেকে শুরু করে ৩ দশমিক ২৪ ইউরো হয়ে থাকে। যেমন সকাল ৬টা ৩০ মিনিট থেকে ৬টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত সর্বনিম্ন ফি নেওয়া হয়, যা ৩০ মিনিট পর পর কম-বেশি হয়। ম্যানহ্যাটন: আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহ্যাটনের কিছু কিছু রাস্তায় কনজেশন ফি নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা চালুর প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই ফি নেওয়া হবে। ছোট গাড়ির জন্য ৮ ডলার ও ট্রাকের জন্য ২১ ডলার নেওয়া হবে। মালয়েশিয়া: মলয়েশিয়ায়ও কনজেশন রোড প্রাইজিং (যানজট ফি) রয়েছে। তবে তাদের ক্ষেত্রে কখন কত ফি তা আগে থেকে জানানো হয় না। রাস্তায় নামলে বুঝতে পারা যায় আজ কত টাকা দিতে হবে। গাড়ি কম থাকলে টাকা কম, কিন্তু বেশি থাকলে টাকাও বেশি দিতে হবে। যদি দেখে শহরে কোনো যানজট নেই, তখন কনজেশন ফি জিরো। আর যেদিন বেশি গাড়ি থাকবে সেদিন বেশি টাকা দিতে হবে। দিনের কখন ট্র্যাভেল করছে, সেই সময়ের ওপর নির্ভর করে ফি নির্ধারণ হবে। মানুষকে আগে থেকে জানতেও দেওয়া হয় না যে, আজকে বা আগামীকাল কনজেশন কত হবে। এ জন্য রেডিও শুনতে বলা হয়। এটা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়। স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, সিঙ্গাপুরের সিস্টেম অনুসরণ করলে পথচারীবান্ধব পথ, গণপরিবহন, সাইকেল ব্যবহারের জন্য জায়গা পাওয়া যাবে। একটি বাস ২০-৩০টি গাড়ি (প্রাইভেট কার) রিপ্লেস করতে পারে। এতে সড়কের সক্ষমতা বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যে লোকটি বেশি গাড়ি ব্যবহার করছে, তার কাছ থেকে তত বেশি ফি নিয়ে তা গণপরিবহনের পেছনে ব্যয় করা উচিত। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক বলেন, ঢাকা শহরকে বাঁচাতে, মেয়র সরকারের সঙ্গে বসে যা করতে পারেন তা হলো ছোট ছোট গাড়িকে লাইসেন্স না দেওয়া। একটা পরিবারে একটার বেশি গাড়ি না দেওয়া। সরকার যে সফট লোনের ব্যবস্থা করে আমলাদের গাড়ি, ড্রাইভার, তেল দিচ্ছে তা নিরুৎসাহিত করা। বিভিন্ন প্রজেক্টে গাড়ি কম দেওয়া। এ বিষয়ে ড. হক বলেন, ‘মেয়রের ভাবনাকে সাধুবাদ জানাই। কারণ মেয়রদেরই এই ধরনের চিন্তাভাবনা করতে হবে। ঢাকা শহরের যে জটিল অবস্থা, তা সমাধানে রাজনৈতিকভাবে অনেক বড় ঝাঁকি দিতে হবে।’
Link copied!