শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তিন ব্যাংকের ৩২৭০ কোটি টাকা ঋণের নামে লুটেরাদের হাতে!

প্রকাশিত: ০৯:১৮ এএম, অক্টোবর ৩, ২০২২

তিন ব্যাংকের ৩২৭০ কোটি টাকা ঋণের নামে লুটেরাদের হাতে!

ডেইলি খবর ডেস্ক: তিন ব্যাংকের ৩২৭০ কোটি টাকা ঋণের নামে লুটেরাদের হাতে চলে গেছে বলে ঋণ সন্দেহ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাম্প্রতিক সময়ে শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের তথ্য যাচাই ছাড়াই অস্বাভাবিক ঋণ সৃষ্টির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে। বলা হয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেওয়া হচ্ছে তারা একেবারে নতুন কিংবা অপরিচিত। দেশের তিন ব্যাংকের ৩২৭০ কোটি টাকা দেওয়া ঋণ বেনামি বলে সন্দেহে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রাজশাহীভিত্তিক নাবিল গ্রæপের নামে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে (আইবিবিএল) ঋণ ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। হঠাৎ করে গ্রæপটির নামে আরও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ওই গ্রæপের একেবারে নতুন দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে আইবিবিএলসহ তিনটি ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার ঋণ সৃষ্টি হলেও এর মধ্যে নতুন গ্রাহকের নামে নেওয়া অন্তত ৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা বেনামে অন্য কোনো পক্ষ নিয়েছে বলে ধারণা করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ। এ বিষয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের অনুমোদন পেলে এ বিষয়ে পরিদর্শন শুরু হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসব ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ আগে থেকেই ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক। ব্যাংকটির রাজশাহী শাখায় চলতি বছরের মার্চে তাদের ঋণ ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। গত ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ৩০৮তম সভায় আগের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হয়। একই সভায় একক গ্রাহকের ঋণ সীমা লঙ্ঘন করে নতুন করে আরও ৭০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়। কিছুদিন পরে ইসলামী ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির সভায় নাবিল গ্রুপের নতুন প্রতিষ্ঠান নাবিল গ্রেইন ক্রপসের নামে ৯৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়। এ ছাড়া গত ৩০ মে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১তম পর্ষদ সভা থেকে নাবিল নব ফুডের নামে আরেকটি নতুন প্রতিষ্ঠানের নামে ১ হাজার ১২০ কোটি এবং ২৩ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৪৬তম সভা থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়। এই তিনটি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা, যা বেনামি বলে সন্দেহ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নাবিল গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ করে এ ঋণ সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করার কারণে প্রয়োজন বেড়েছে। তার নামে অন্য কেউ ঋণ নেওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়। পুরো ঋণের সুবিধাভোগী নাবিল গ্রæপ। ব্যবসার প্রয়োজনে তিনি এ ঋণ নিয়েছেন। তিনি এ দাবি করলেও ইসলামী ব্যাংকের নথিতে নাবিল গ্রেইন ক্রপস নাবিল গ্রæপের প্রতিষ্ঠান নয় বলে দাবি করা হয়েছে।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুলশান শাখার নতুন গ্রাহক নাবিল গ্রেইন ক্রপসের নামে ৯৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ সীমা অনুমোদন করা হয়েছে। মাত্র ১১০ কোটি টাকার আমানত লিয়েন রাখার শর্তে কৃষিপণ্য আমদানি ও বিপণনের জন্য এ ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। ট্রেডিংয়ের জন্য বিপুল অঙ্কের ঋণ দেওয়া হলেও হালনাগাদ সিআইবি প্রতিবেদন অনুযায়ী গ্রাহকের এ পর্যন্ত লেনদেন মাত্র সাড়ে ৮ লাখ টাকা। আবার প্রতিষ্ঠানটি 'কোনো গ্রæপভুক্ত নয়' বলে ব্যাংকের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। আর গ্রাহকের প্রাক্কলিত আর্থিক বিবরণীর ভিত্তিতে ঋণ ঝুঁকির রেটিং দেওয়া হয়েছে 'প্রান্তিক'। এ রকম গ্রাহকের অনুকূলে ট্রেডিংয়ের জন্য বিনিয়োগ সঠিক খাতে ব্যবহার হয়েছে কিনা এবং এত বড় ব্যবসা পরিচালনার প্রয়োজনীয় দক্ষতা তাদের রয়েছে কিনা যাচাই করা আবশ্যক। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি নাবিল গ্রæপের অন্তর্ভুক্ত কিনা তাও পরিদর্শন করা দরকার। নাবিল নব ফুডের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ প্রতিষ্ঠানের নামে সৃষ্ট ঋণ বেনামি বা ফার্স্ট সিকিউরিটি এবং এসআইবিএলের বা অন্য কোনো ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থ-সংশ্নিষ্ট কিনা যাচাই করা আবশ্যক। আবার ঋণ অনুমোদনের সময় দেওয়া ন্যূনতম শর্ত পরে শিথিল করা হয়েছে। নতুন একটি বিনিয়োগ হিসাবের বিপরীতে কোন বিবেচনায় শর্ত শিথিল করা হলো তা জানা দরকার। সার্বিক পর্যালোচনা শেষে নতুন একজন গ্রাহকের অনুকূলে এত বিপুল পরিমাণের বিনিয়োগ অনুমোদনের যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে ব্যাংক দুটির কাছে। এ ছাড়া নাবিল নব ফুডের পরিচালকদের ব্যবসায়িক ইতিহাস জানাতে বলা হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ইসলামী ব্যাংকের এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা, এসআইবিএলের এমডি জাফর আলম এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলীর সঙ্গে বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। ইসলামী ব্যাংক ও এসআইবিএলের প্রধান কার্যালয়ে গিয়েও দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য নেওয়া যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন,সাম্প্রতিক সময়ে শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের তথ্য যাচাই ছাড়াই অস্বাভাবিক ঋণ সৃষ্টির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেওয়া হচ্ছে তারা একেবারে নতুন কিংবা অপরিচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে বেনামে কোনো পক্ষ বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে। এখন নাবিল গ্রæপের নামে বিপুল অঙ্কের ঋণেও অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েছে। পরিচালনা পর্ষদ বা মালিকানার সঙ্গে যুক্ত কারও সম্পৃক্ততা ছাড়া বিপুল অঙ্কের এ ঋণ সৃষ্টি সম্ভব নয়। সার্বিক তথ্য পর্যালোচনা করে প্রাথমিকভাবে তাদের ধারণা নাবিল গ্রæপের ঋণ ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বাকি ৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকার সুবিধাভোগী অন্য কোনো পক্ষ। একক গ্রাহকের ঋণসীমা মানা হয়নি: ব্যাংক কোম্পানি আইনে একটি ব্যাংক তার মোট মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রæপকে ঋণ দিতে পারে। ফান্ডেড, নন-ফান্ডেড মিলে কোনো ব্যাংক এর চেয়ে বেশি ঋণ দিলে তা হবে আইনের লঙ্ঘন। গত জুন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের মোট মূলধন রয়েছে ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এর মানে একক গ্রাহককে ব্যাংকটি সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে। অথচ ব্যাংকটি থেকে নাবিল গ্রেইন ক্রপসসহ নাবিল গ্রæপের নামে ঋণ ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট ৩ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে একক গ্রাাহককে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে ৯৩০ কোটি টাকা। অথচ নাবিল নব ফুডকে ব্যাংকটি দিয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে একক গ্রাহককে সর্বোচ্চ ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে ৮১৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটি নাবিল নব ফুডকে দিয়েছে ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা।এসব ঋণের টাকা আদায় নিয়ে চলছে নানামুখী সমালোচনা।সুত্র-সমকাল  
Link copied!