মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

থেমে নেই ব্যয়ের গতি, এক প্রকল্পেই ৩২০০ পরামর্শক

প্রকাশিত: ১১:১১ এএম, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১

থেমে নেই ব্যয়ের গতি, এক প্রকল্পেই ৩২০০ পরামর্শক

উন্নয়ন প্রকল্পে থেমে নেই পরামর্শক ব্যয়ের গতি। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোনো ক্ষেত্রে এই পরামর্শক ব্যয় যৌক্তিক আবার কোনো ক্ষেত্রে তা অযৌক্তিক। কিছু ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার নানা শর্তের ওপর নির্ভর করে পরামর্শক ব্যয় নির্ধারণ করতে হয়। বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকল্পের ব্যয়, মালপত্র ক্রয়, পরামর্শক ব্যয় সব সংক্ষিপ্ত আকারে থাকে। বিস্তারিত কিছুই সেখানে উল্লেখ থাকে না। তেমনি একটি প্রকল্প হচ্ছে গত আগস্ট মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে পাস হওয়া ‘অ্যাকসেলারেটিং অ্যান্ড স্ট্রেনসিং স্কিলস ফর ট্রান্সফরমেশন (এএসএসইটি)’ প্রকল্প। প্রশিক্ষণবিষয়ক এই প্রকল্পের পরামর্শক খাতে ব্যয় হবে প্রায় ১৪৪ কোটি টাকা। তবে ঠিক কোন কাজে কিভাবে পরামর্শকদের জন্য এই টাকা খরচ করা হবে তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি ডিপিপিতে। ওই একই মাসে অনুমোদন পাওয়া আরেকটি প্রকল্পেও পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। এএসএসইটি প্রকল্পের তথ্যে দেখা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় যুবসমাজ, নারী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়নে ব্যয় হবে চার হাজার ২৯৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার ৭১৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে দুই হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ প্রকল্পে পরামর্শকের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, তিন হাজার ২০০ জন (জনমাস) দেশি-বিদেশি পরামর্শকের জন্য মোট প্রস্তাবিত ব্যয়ের মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ৪২ কোটি ৮০ লাখ টাকা খরচ করা হবে। বাকি ১০১ কোটি আট লাখ টাকা ব্যয় হবে বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে। পরামর্শক খাতের এ ব্যয় প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৩.৩৫ শতাংশ। চলতি বছরের ১৮ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়ন প্রকল্পে ঢালাওভাবে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ না দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, প্রকল্পের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার ততটুকু বিদেশি পরামর্শক নিতে হবে। ঢালাওভাবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। সেই বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, চোখ বন্ধ করে উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি পরামর্শক নেওয়া যাবে না।’ এএসএসইটি প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ১৪৪ কোটি খরচ ধরার বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম বলেন, ‘টাকার অঙ্কে এই ব্যয় বেশি মনে হলেও এটা কিন্তু মোট ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম। শতাংশের হারে তা ৩.৩৫ শতাংশ, যা একবারেই কম। আর এখানে যাঁরা দেশি-বিদেশি পরামর্শক আসবেন তাঁরা পরামর্শ দেবেন কিভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যায়, কিভাবে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়ানো যায়।’ এই প্রকল্পটির মূল কাজ হচ্ছে তিনটি—অনাবাসিক ভবন নির্মাণ, ১৫ একর জমি অধিগ্রহণ এবং প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ অনুদান, প্রকল্প অনুদান। এ ছাড়া পরামর্শক, সেমিনার ও কনফারেন্স ব্যয়, তথ্য ও যোগাযোগ (আইসিটি) সরঞ্জাম ক্রয়, অফিস সরঞ্জাম, আসবাব, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হবে। পাশাপাশি সমন্বিত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ (টিভেট) খাতে কভিড-১৯ মোকাবেলা সংক্রান্ত সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়তা দেওয়া হবে। জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এডিবির কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। পরামর্শক মূলত নিয়োগ দেওয়া হয় প্রকল্পের স্বার্থে। কিছু প্রকল্পের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের চাহিদা থাকে এটা ঠিক। তবে তা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে। অপ্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের ঋণে এ ধরনের বিষয় থাকার কথা নয়। কিছু প্রস্তাবিত প্রকল্পে কী ধরনের এবং কোন খাতে পরামর্শক লাগবে সেটি পরিষ্কার নয়। পরিকল্পনা কমিশনের উচিত বিষয়টি আরো গভীরভাবে খতিয়ে দেখা।’ পরামর্শকের পেছনে ৫০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে অনুমোদন দেওয়া আরেকটি প্রকল্প হলো ‘স্টিল আর্চ ব্রিজ’ নির্মাণ প্রকল্প। ময়মনসিংহের কেওয়াটখালীর ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মাণ হতে যাচ্ছে এই সেতু। সেতুটির বৈশিষ্ট্য হলো নদের দুই পাশে পিলার থাকলেও মাঝে কোনো পিলার বসানো হবে না। অনেকটা ধনুকের মতো এই সেতু দেখতে পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ার শহর সিডনির হার্বারে। প্রকল্পটির আওতায় ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ৩২০ মিটার স্টিল আর্চ ব্রিজ নির্মাণ, ৭৮০ মিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক, ২৪০ মিটার রেলওয়ে ওভারপাস, ৫৫১ মিটার সড়ক ওভারপাস, ৬.২০ কিলোমিটার এসএমভিটিসহ চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণ এবং একটি টোল প্লাজা নির্মাণ করা হবে। মোট ব্যয় হবে তিন হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে এশিয়ার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) ঋণ হিসেবে দেবে এক হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। বাকি টাকা রাষ্ট্রের নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করা হবে। পরামর্শক ব্যয় বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আরো বলেন, ‘আসলে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কিছু চাহিদা থাকে। স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের বেশ কিছু নিয়মের বেড়াজালে পড়তে হয়, যা আদতে আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে যায়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কিছু প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় টাকার অঙ্কে বেশি দেখা যায়, আসলে এটা খুব টেকনিক্যাল বিষয়। প্রকল্প বিষয়ে ঢালাওভাবে মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো মানতে চায় না যে আমরা সক্ষম হয়েছি। আমরা এসব নিয়মের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।’
Link copied!