বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দীর্ঘ নজরদারির পর জাওয়াহিরিকে হত্যা

প্রকাশিত: ০২:০৮ পিএম, আগস্ট ৩, ২০২২

দীর্ঘ নজরদারির পর জাওয়াহিরিকে হত্যা

ড্রোন হামলা চালিয়ে আল-কায়দার শীর্ষ নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরিকে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক ঘোষণায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ৭১ বছর বয়সি জাওয়াহিরিকে হত্যার জন্য হামলা চালাতে তিনি অনুমোদন দিয়েছিলেন। এ জন্য কয়েক মাস ধরে পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। তবে আল-কায়দার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। ১৯৫০ সালে মিসরের এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আয়মান আল জাওয়াহিরি। জঙ্গিবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার আগে তিনি মূলত একজন সার্জন ছিলেন। বারবার কারাবরণও করেন। তিনি এক পর্যায়ে পাকিস্তানে গিয়ে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজাহিদীন যোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। পরিচয় হয় সৌদি পৃষ্ঠপোষক ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে। দুজন মিলে গড়ে তোলেন জঙ্গিগোষ্ঠী। ২০১১ সালে পাকিস্তানে এক অভিযানে লাদেনকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জাওয়াহিরি। তাকে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে চালানো হামলার মূল রূপকার বলে মনে করেন অনেকে। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ২২ ‘মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী’ তালিকায় দুই নম্বরে তার নাম ছিল। এক নম্বরে ছিল ওসামা বিন লাদেনের নাম। সে সময় জাওয়াহিরির মাথার জন্য ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। জো বাইডেন বলেন, জাওয়াহিরির বিরুদ্ধে মার্কিন নাগরিকদের হত্যা ও সহিংসতার প্রমাণ রয়েছে। তার ভাষায়, ‘এখন ন্যায়বিচার হয়েছে এবং এই সন্ত্রাসী নেতা আর বেঁচে নেই। এর জন্য কতদিন সময় লেগেছে, সেটা বড় বিষয় নয়। কোথায় লুকিয়ে ছিল সেটাও কোনো ব্যাপার নয়। তুমি যদি মার্কিন নাগরিকদের জন্য হুমকি হও, তা হলে আমেরিকা তোমাকে খুঁজে বের করবে।’ বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, রোববার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) পক্ষ থেকে এই ড্রোন হামলা চালানো হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, মার্কিন ড্রোন থেকে যখন দুটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয় তখন জাওয়াহিরি একটি সেফ হাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। ওই সময়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যও বাড়িটিতে উপস্থিত ছিলেন। তবে তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। যেভাবে হত্যা করা হয় জাওয়াহিরিকে : চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন প্রশাসন। তবে আল জাওয়াহিরির মৃত্যু সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পরই তা ঘোষণা করা হয়েছে। তাই ঘোষণায় একটু দেরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। বাইডেন বলেছেন, অপারেশন সফল হয়েছে এবং কোনো বেসামরিক মানুষ মারা যাননি। তিনি গত সপ্তাহে এই অপারেশনের ছাড়পত্র দিয়েছিলেন এবং শনিবার তা কার্যকর হয়। বাইডেন বলেছেন, ‘আল জাওয়াহিরি কাবুল গিয়েছিলেন তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু অপারেশনে তার পরিবারের কেউ হতাহত হয়নি।’ দেশটির জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা চলে যাওয়ার পর আল-কায়দা সেখানে তাদের সংগঠন আবার গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। অনেকদিন ধরে ধারণা করা হচ্ছিল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে লুকিয়ে আছেন জাওয়াহিরি। চলতি বছর মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, পরিবার নিয়ে কাবুলে চলে এসেছেন তিনি। মার্কিন প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জাওয়াহিরিকে হত্যা করার জন্য পরিকল্পনা বীজ বোনা হয়েছিল বছরখানেক আগে। আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানোর সময় থেকে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হতে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াশিংটনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জাওয়াহিরির সঙ্গে আল-কায়দার যে নেটওয়ার্কের সরাসরি যোগাযোগ ছিল তাদের ওপর বছরখানেক আগে থেকেই নজরদারি শুরু হয়। ফলে জাওয়াহিরির অবস্থানও জানা যায়। জাওয়াহিরি কী করেন, কী খান, কোথায় যান- গত কয়েক মাস ধরে তার জীবনযাপনের ওপর নজর রাখছিলেন আমেরিকার গোয়েন্দারা। এ নিয়ে ওয়াশিংটনের কর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও রাখতেন গোয়েন্দারা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একের পর এক গোপন বৈঠক করেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সেই সময়ই স্থির হয়ে যায় জাওয়াহিরিকে হত্যার পরিকল্পনা। জাওয়াহিরি কাবুলের যে অংশে রয়েছেন, অপারেশন চলাকালে সেখানে যাতে আরও কোনো ক্ষয়ক্ষতি না ঘটে সেই দিকটি নিয়েও আলোচনা হয় ওয়াশিংটনের ওই বৈঠকে। গত ২৫ জুলাই আরও একটি গোপন বৈঠকে জাওয়াহিরির বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর অনুমোদন দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে শর্ত দেওয়া হয়, ওই অভিযানের সময় যাতে কোনো সাধারণ মানুষের মৃত্যু না ঘটে। বৈঠকের ঠিক পঞ্চম দিনের মাথায় অর্থাৎ ৩০ জুলাই সকালে ড্রোনের মাধ্যমে কাবুলে অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ড্রোনে ছিল ‘হেলফায়ার’ নামে এক ধরনের বিশেষ ক্ষেপণাস্ত্র। যার আঘাতে ওই সেফ হাউসের বারান্দায় মৃত্যু হয় আল-কায়দা প্রধানের। কর্মকর্তারা বলছেন, যখন মার্কিন ড্রোন থেকে দুটি মিসাইল হামলা চালানো হয়, তখন জাওয়াহিরি একটি সেফ হাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন পরিবারের অন্যান্য সদস্যও সে বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। মার্কিন সংবাদ সংস্থা এপি জানিয়েছে, যে বাড়িতে আল জাওয়াহিরিকে মারা হয়েছে, সেটা তালেবান নেতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানির এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর। এই অপারেশনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। ইতোমধ্যে তালেবান এই হামলার নিন্দা করেছে। আফগান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাবুলে ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করেছিল। তবে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ মঙ্গলবার সকালে বলেছেন, কাবুলের শেরপুর এলাকায় একটি বাড়ির ওপর মার্কিন ড্রোন হামলা হয়েছে। তালেবান সরকার একটি বিবৃতি দিয়ে মার্কিন ড্রোন হামলার নিন্দা করেছে। তারা জানিয়েছে, এই কাজ ২০২০ সালের দোহা চুক্তির বিরোধী। এই ধরনের প্রয়াস গত ২০ বছরে বারবার হয়েছে। এই প্রয়াস যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান এবং এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর বিরোধী। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভ্যালের ওয়াশিংটন প্রতিনিধি সুমি সোমাসকান্ডা বলেছেন, জাওয়াহিরির মৃত্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উচ্ছ্বসিত, কিন্তু গত বছর যে বিশৃঙ্খলভাবে সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছিল, তা নিয়ে এখনও ক্ষোভ রয়েছে। তার মতে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা চলে আসার ১১ মাসের মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী এই অপারেশনকে বড় সাফল্য হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে চলে এসেছে ঠিকই, কিন্তু এখনও তারা সেখানকার সুরক্ষা পরিস্থিতি নিয়মিত খতিয়ে দেখছে।
Link copied!