বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

দুই প্রতিপক্ষ সামলাচ্ছেন আইভী

প্রকাশিত: ১১:৫৩ এএম, জানুয়ারি ১০, ২০২২

দুই প্রতিপক্ষ সামলাচ্ছেন আইভী

শীতের দুপুরে শীতলক্ষ্যা পার হব। নারায়ণগঞ্জ শহরের এক নম্বর সেন্ট্রাল ফেরিঘাট থেকে যে নৌকায় উঠলাম, তার ছইজুড়ে বিরাট বিরাট সাদা-কালো পোস্টার। পোস্টারে সেলিনা হায়াৎ আইভীর ছবি। তাঁর ছবির পাশে নৌকার ছবি। বড় বড় ছাপার অক্ষরে লেখা ‘আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-মনোনীত ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে নৌকায় ভোট দিন’। দূষণে কালির মতো কালো হয়ে যাওয়া নদীর বুকজুড়ে কয়েক শ নৌকা। প্রতিটি নৌকার ছই এই পোস্টারে ছাওয়া। ‘আইভীময় শীতলক্ষ্যা’ পার হয়ে বন্দরঘাটে নামতেই দেখা গেল তোরণের মতো বিশাল গেট। গেট পার হলেই রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার দুই ধার আর মাথার ওপর অসংখ্য-অগণিত পোস্টার। সেসব পোস্টারের সবই যে নৌকার, তা নয়। স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারের হাতি মার্কার পোস্টারও আছে। আর আছে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদেরও। শহরে পা ফেলামাত্র বোঝা যাচ্ছিল সামনে নির্বাচন। সারা দেশে স্থানীয় পর্যায়ে যে ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নিস্তরঙ্গ নির্বাচন দেখে দেখে মানুষের ভোট দেওয়ার ইচ্ছাটাই মরণাপন্ন অবস্থায় চলে গেছে, এটি সেই নির্বাচন নয়। উৎসবমুখর নির্বাচনী পরিবেশ বলতে যা বোঝায়, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। স্থানীয় কয়েকজন সংবাদকর্মী ও ভোটারের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, দেশের অন্য এলাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে এক করে দেখার সুযোগ নেই। এখানকার মানুষ আশা করছে এই সিটির নির্বাচনে সত্যিকার অর্থে ভোট হবে। মানুষ ভোট দিতে আসবে। সেই ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। এই আশাবাদের কারণেই চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সবখানে ভোটের হিসাব-নিকাশ নিয়ে আলোচনা চলছে। সেই আলোচনায় সেলিনা হায়াৎ আইভীর প্রতিপক্ষ হিসেবে যতটা না তৈমুর আলম খন্দকারের নাম আসছে, তার চেয়ে বেশি আসছে স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানের নাম। অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে আইভীকে মূলত দুজন প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। একজন প্রকাশ্য। আরেকজন পর্দার অন্তরালের। প্রকাশ্যজনের নাম তৈমুর আলম খন্দকার। তিনি বিএনপি থেকে অব্যাহতি পেয়ে এখন ‘নির্দলীয়’। স্বতন্ত্র। ‘ধানের শীষ’ ছেড়ে এখন ‘হাতি’তে। বিএনপির সঙ্গে তৈমুরের ছাড়াছাড়ি হলেও তারা এখনো ‘ভালো বন্ধু’। অবশ্য স্থানীয় অনেকের মত, স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে তৈমুরের দ্বন্দ্ব আছে। তৈমুর যদি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির প্রার্থী হতেন, তাহলে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে ওই নেতারা তাঁকে সমর্থন দিতেন। কিন্তু এখন যেহেতু তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী, সেহেতু তাঁকে সমর্থন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তাঁদের নেই। এ কারণে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের নিরঙ্কুশ সমর্থন তৈমুর পাচ্ছেন না। বিএনপির একটি অংশের ভোট আইভী এবং হাতপাখার প্রার্থী মুফতি মাসুম বিল্লাহের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। আইভীর পর্দার আড়ালে থাকা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লোকজন যাঁর নাম বলছেন, তিনি হলেন শামীম ওসমান। সরকারদলীয় সাংসদ হিসেবে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার জায়গা থেকে হলেও শামীম ওসমানের আইভীকে সমর্থন দেওয়ার কথা ছিল। প্রকাশ্যে তিনি তা দিচ্ছেন বলে নিরন্তর দাবিও করে যাচ্ছেন। কিন্তু শামীম ওসমানের সমর্থন দেওয়ার কথা বিশ্বাস করেন—এমন লোক চেষ্টা করেও খুঁজে পেলাম না। এ বিষয়ে যতজনের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁদের সবাই নিশ্চিত, শামীম ওসমান তৈমুরের হয়ে কাজ করছেন। আইভীকে যেভাবেই হোক পরাজিত করতে হবে—এমন অঘোষিত নির্দেশ তিনি অনুগামীদের দিয়ে রেখেছেন। অর্থাৎ এখানে নৌকার মধ্যেও বড় ধরনের দলাদলি সামলাতে হচ্ছে আইভীকে। সেই ধারণার ভিত্তি কতটা পোক্ত, তা দেখতেই শীতলক্ষ্যা পার হয়ে সামনের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি। কারণ, বন্দর এলাকায় সেলিনা হায়াৎ নির্বাচনী মিছিল নিয়ে বের হয়েছেন। সে কারণেই আমার গন্তব্য সেদিকে। মিনিট দশেক হাঁটার পর চিতাশাল নামের জায়গায় দেখা গেল মিছিল এগিয়ে আসছে। শ পাঁচেক লোকের মাঝারি সাইজের একটা মিছিল। স্লোগানমুখরিত মিছিলের মাঝখানে একটা মোটরচালিত রিকশায় আইভী বসে আছেন। রাস্তার দুপাশের মানুষকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছেন তিনি। এই মিছিলের সঙ্গে চলমান অন্যান্য স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনী মিছিলের একটা স্পষ্ট পার্থক্য দেখা গেল। মিছিলে যোগ দেওয়া মানুষগুলোর দেহভাষায় যে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা গেল, তাতে বোঝা যাচ্ছিল তারা ‘ভাড়া করা লোক’ নন। প্রায় প্রত্যেকের মুখে আইভীর আত্মীয় গোছের মানুষের অভিব্যক্তি ছিল চোখে পড়ার মতো। মিছিলে আসা লোকদের মধ্যে শামীম ওসমানের কোনো অনুসারী আছেন কি না, সেই খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সে ধরনের কেউ নেই। অর্থাৎ আইভীকে অসহযোগিতা করার যে অভিযোগ শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে আছে, তার একটা ছোট্ট নজির এখানে পাওয়া গেল। অন্যদিকে, তৈমুর যে বিএনপির নিরঙ্কুশ সমর্থন পাচ্ছেন না, তাও আইভীর মিছিল দেখে বোঝা গেল। কারণ, মিছিলে বিএনপির একজন বর্তমান কাউন্সিলরকে দেখা গেল। একটা সময় মিছিল থামালেন আইভী। সংবাদকর্মীরা ছেঁকে ধরলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যে উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা যাচ্ছে, তা কি শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভোটের মাধ্যমে শেষ হবে?’ তিনি বললেন, তৈমুর আলম খন্দকার সম্পর্কে তাঁর চাচা হন। চাচা-ভাতিজির মধ্যে কোনো সংঘাত হবে না বলে তিনি বিশ্বাস করেন। শান্তিপূর্ণ ভোট হবে বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। মিছিলের অদূরে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে দেখা গেল। একজন স্থানীয় সাংবাদিক বললেন, আগে আইভীর মিছিলের কাছে এভাবে পুলিশ দেখা যেত না। দুদিন আগে থেকে পুলিশের প্রহরা বেড়েছে। আইভী সমর্থকদের ওপর হামলা হতে পারে, এমন একটি আশঙ্কা করছে পুলিশ—এই ধারণা জনমনেও ছড়িয়ে পড়েছে। আসলে ভোটাররা আইভীকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে যতটা না দেখছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি দেখছেন ব্যক্তি আইভীকে। সেই ব্যক্তি আইভী ‘নৌকার প্রার্থী আইভী’কে অতিক্রম করে গেছেন।  
Link copied!