শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই ভাই আর ‘মাসতুতো ভাই’ লুটেছে ৩১৬ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ১২:৪৭ পিএম, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২২

দুই ভাই আর ‘মাসতুতো ভাই’ লুটেছে ৩১৬ কোটি টাকা

সরকারের অর্ধেক মালিকানার তেল কোম্পানি এসএওসিলের ৩১৬ কোটি টাকা লোপাট করেছেন তিন ব্যক্তি। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ ১৫০ কোটি টাকা এবং হিসাব বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ মাহমুদুল ২১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আর ১৪৬ কোটি টাকা আত্মসাৎকারী মঈন উদ্দিন আহমেদ এসএওসিলের বেসরকারি দুই অংশীদারের একজন। এদের মধ্যে শাহেদ ও মাহমুদুল আপন খালাতো ভাই। ২০২০ সালের আগস্টে শাহেদ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত বছরের মার্চে মঈন উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করে। কিন্তু মালয়েশিয়া, ঢাকা ও চট্টগ্রামে থাকা শাহেদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ উদ্ধারের চেষ্টা করেনি সংস্থাটি। মাহমুদুলের বিরুদ্ধে কোনো মামলাই হয়নি। স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) সাবেক নাম ছিল ‘এসো’। জ্বালানি তেল, এলপিজি ছাড়াও নানা ধরনের লুব্রিকেন্ট তেল প্রতিষ্ঠানটির পণ্য। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয়করণ হয়। পরবর্তী সময় প্রতিষ্ঠানটির অর্ধেক সরকারের মালিকানায় রেখে দুজন বেসরকারি অংশীদারকে যুক্ত করা হয়। সরকারের অংশের মালিকানা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হাতে। বাকি মালিকানায় দুই ভাই মঈন উদ্দিন আহমেদ ও মিশু মিনহাজ। দুর্নীতি দমন কমিশন মঈন উদ্দিনের বিরুদ্ধে ৩৮ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে মামলা করে। মিশু মিনহাজ ২০২০ সালের ১৫ জুলাই রাজধানীর পল্টন থানায় তার ভাই মঈনের বিরুদ্ধে ১৪৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১০ সাল থেকে তিন বছরে এসএওসিএল থেকে অগ্রিম হিসেবে মঈন নিয়েছেন ৫৩ কোটি টাকা। ওই অর্থ ফেরত দেননি। ২০১৫ থেকে তিন বছরের মধ্যে মঈন উদ্দিনের নিজের কোম্পানি পিরামিড এক্সিম পাওয়ারের নামে চেকের মাধ্যমে সরিয়েছেন ৪৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। আবার ২০১১ সাল থেকে পরের এক বছরে এসএওসিলের ৪৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি কোম্পানির হিসাবে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন মঈন। এভাবে এসএওসিল থেকে মোট ১৪৬ কোটি টাকা লোপাট করেছেন মঈন উদ্দিন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিষয়টি এখন দুদকের হাতে। একজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, আরেকজন অভিযুক্ত মারা গেছেন। যদি লোপাট করা অর্থ কোথাও গোপন করা থাকে সেটি অনুসন্ধানের জন্য আমরা দুদককে অনুরোধ জানাব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন করে আবার এসএওসিএলের অর্থ লোপাটের তথ্য আমার জানা নেই। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও তিনি জানান। দেড় বছরে ২১ কোটি টাকা আত্মসাৎ! শাহেদ তার কাছের অনেক আত্মীয়কে নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই এসএওসিএলে চাকরি দিয়েছেন। এদের একজন তার খালাত ভাই মোহাম্মদ মাহমুদুল হক। শাহেদের প্রভাবে অল্প সময়ে পদোন্নতি পেয়ে হয়ে যান উপ-ব্যবস্থাপক। এখন তিনি প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বিভাগের প্রধান। খালাত ভাই শাহেদ মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের মতো একই কৌশলে সহকর্মী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া ভাউচার বানিয়ে ২১ কোটি টাকা তুলে নেন মাহমুদুল। এ বিষয়ে জানতে মোহাম্মদ মাহমুদুল হক মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও ম্যাসেজ দিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জুনিয়র সেলস অফিসার মো. শাহাদত হোসেনের নামে গত ১ জুন প্রতিষ্ঠানটির এনআরবি ব্যাংক থেকে একটি চেকের মাধ্যমে ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা নগদ তুলে নেয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত ১১ সেপ্টেম্বর টেলিফোনে শাহাদত হোসেন বলেন, ‘আমি কোনো চেক দিয়ে টাকা তুলিনি। এই বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই নেই।’ ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় কর্মকর্তা সুলতানা আক্তার চৌধুরীর নামে এনআরবি ব্যাংকের একটি চেকের মাধ্যমে ৬ লাখ ১২ হাজার ৬০০ টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়। গত ১১ সেপ্টেম্বর টেলিফোনে সুলতানা আক্তার চৌধুরী বলেন, ‘এগুলো আমি কিছুই জানি না। আমার কাজ পণ্য বিক্রি করে বিক্রির টাকা কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া। আমার নামে টাকা তুলে নিচ্ছে অন্য কেউ অথচ সেটা আমি জানি না, এটা খুবই অবাক করার মতো বিষয়।’ ২০২০ সালের ৫ মে প্রতিষ্ঠানটির আরেক কর্মকর্তা আবদুল্লা সিফাতের নামে ১২ লাখ টাকার একটি নগদ চেক রেজিস্টারে ইস্যু করা হয় লুব তেল কেনা বাবদ। অথচ এসএওসিএল নিজেই লুব তেল বিদেশ থেকে আমদানি করে পাইকারি বিক্রি করে। সিফাতের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব না হলেও তার বিষয়টি উঠে এসেছে এসএওসিএলের ৪১২তম বোর্ডসভার প্রতিবেদনে। এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনায় ২১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা লোপাটের তথ্য পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। গত বছরের ৪ নভেম্বর অনলাইন প্লাটফর্ম জুমে এসএওসিএলের ৪১২তম বোর্ডসভা হয়। সেখানে বলা হয়, এসএওসিএলের বিভিন্ন কর্মকর্তার নামে ৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে হিসাব বিভাগের প্রধান মাহমুদুল হক সরিয়ে নিয়েছেন। গত বছরের নভেম্বরের ওই বোর্ড সভার পর থেকে এ পর্যন্ত আরও অন্তত ১২ কোটি টাকা নগদ তুলে নিয়ে লোপাটের তথ্য মিলেছে অনুসন্ধানে। এসএওসিএলের দুজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কোম্পানির জন্য ২০২০ সালে ৩৮ লাখ টাকার থালা-বাসন কেনার নামে টাকা তুলে নেয়া হলেও বাস্তবে ২০ হাজার টাকারও কেনা হয়নি। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, এসএওসিএলে সরকারের আধা মালিকানা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রায় ৩১৬ কোটি টাকা লুটে নেয়ার প্রমাণ রয়েছে। সেই মামলার অগ্রগতি কম। নতুন করে একই কায়দায় ২১ কোটি টাকা লুট করার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবেই লুটপাট করছে কিছু ব্যক্তি। সরকারি প্রতিষ্ঠান যাদের রক্ষা করার কথা তারা অনেক ক্ষেত্রে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। মঈনের টাকা সম্পদ কেনায় এসএওসিএলের অর্থ লোপাটের ঘটনায় দুদকের করা মামলায় গত বছরের মার্চে সংস্থাটি যে অভিযোগপত্র দিয়েছে তাতে মঈন উদ্দিনের বিরুদ্ধে মাত্র ৩৯ কোটি টাকা আত্মাতের অভিযোগ আনা হয়। অন্যদিকে শাহেদ মারা যাওয়ায় তাকে মামলায় আসামি করা হয়নি। যদিও অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, শাহেদ আত্মসাৎ করেছেন ৪২ কোটি টাকা। ওই অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, মঈন উদ্দিন আহমেদ আত্মসাৎ করা টাকায় বিভিন্ন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েছেন। রাজধানীর লালমাটিয়া বি ব্লকে বাড়ি নির্মাণে ব্যয় করেছেন ছয় কোটি টাকা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বি ব্লকে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন স্ত্রী শামীমা আহমেদের নামে। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে ভেনচুরা প্রোপার্টিজে দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। ব্রান্ডস ওনলি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ড. হুমায়ূন নামে এক ব্যক্তিকে গাড়ি কেনা বাবদ দিয়েছেন ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। তবে দুদকের মামলায় ড. হুমায়ূন নামের ব্যক্তিটির পরিচয় দেয়া হয়নি। শাহেদের টাকা গেল কোথায়? ২০১২ থেকে ছয় বছরের মধ্যে শাহেদ এসএওসিএল থেকে নগদে অন্তত ১৫০ কোটি টাকা তুলে নেন। এর মধ্যে ১২১টি নগদ চেকের তথ্যপ্রমাণ দৈনিক বাংলার কাছে আছে। তার লোপাট করা ১৫০ কোটি টাকার একটি অংশ জমা পড়ে গুডউইন পাওয়ার কোম্পানির চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের প্রিমিয়ার ব্যাংকের হিসাবে। শাহেদ ওই কোম্পানির অংশীদার। সরকারের যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে খোলা গুডউইন পাওয়ার কোম্পানির অন্য দুই মালিক হলেন জামাল উদ্দিন ও তার মেয়ে জামাল ফাতিমা মনিকা। শাহেদের মৃত্যুর পর গুডউইন পাওয়ার অন্য দুই মালিকের নিয়ন্ত্রণে আছে। বর্তমানে গুডউইন পাওয়ার ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কে একটি বাড়িতে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহেদ ব্যবসায়ী পরিচয়ে নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্ব নিতে চেয়েছিলেন। এ জন্য চট্টগ্রামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সার্ভে লিমিটেডের কাছ থেকে ২০১৪ সালে সম্পদের মূল্য বিবরণী নেন তিনি, যা জমা দেন নিউজিল্যান্ড দূতাবাসে। ওই বিবরণীর তথ্যমতে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে তার ১৪টি ফ্ল্যাটের মূল্য ১৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ১২টি ফ্ল্যাট, ফেনীর সোনাগাজীর আমিরাবাদে একটি ও রাজধানীর বসুন্ধরায় একটি ফ্ল্যাট আছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের পশ্চিম খুলশীর ইয়াকুব ফিউচার পার্ক এলাকায় ‘ন্যাশনাল পলিটেকনিক কলেজ’ নামে ১০ তলা ভবনটিও শাহেদের। এর পাশেই ১০ কাঠার আরেকটি প্লট আছে শাহেদের। খুলশীর মুরগি ফার্ম এলাকায় ‘ন্যাশনাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কলেজ’ নামে দোতলা ভবনের একটি প্রতিষ্ঠান আছে তার। খুলশী-২ এলাকায়ও একটি পাঁচতলা ভবনের তথ্য পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেতে মালয়েশিয়ায় থাকা তার সম্পদের অর্থমূল্য নিরূপণ করায় জেরাল্ডদিন অ্যান্ড অর্জুন অ্যাসোসিয়েটস নামের একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রত্যায়নপত্রে দেখা যায়, ২০১৩ সালে মালয়েশিয়ার স্টার রেসিডেনস এসডিএন বিএইচডি নামের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বাণিজ্যিক স্পেস কিনেছেন শাহেদ। কুয়ালালামপুরের বান্দারের সিকায়েসেন রোডে ফার্নিসড ওই স্পেস কেনেন ৩০ লাখ ২১ হাজার ৮০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত দিয়ে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ কোটি ৩৩ লাখের বেশি।
Link copied!